No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পাখিদের স্বর্গরাজ্য নেওড়া ভ্যালি

    পাখিদের স্বর্গরাজ্য নেওড়া ভ্যালি

    Story image

    শীত পড়ে গেছে। আনাগোনা শুরু হয়েগেছে পরিযায়ী পাখিদের। তাদের দেখে আমারও স্মৃতিপটে জেগে উঠল নেওড়া ভ্যালির পাখিদের কথা। সেবার আমরা দুই বন্ধু  চললাম লাভা ও নেওড়া ভ্যালি পাখিদের স্বর্গরাজ্যে।পাখি দেখা ও ছবি তোলার নেশা কীভাবে পড়লাম? এরকম অনেক প্রশ্নের মুখমুখি হই।  সব সময় ভাবি এমন কিছু করব যা অন্যদের কাজে আসবে। পাখি দেখার তথ্যগুলো ই-বার্ডের তালিকায় সংরক্ষিত করা। যা ভ্রমণকে করে তোলে অন্য রকম অর্থবহ। ই-বার্ডের তালিকা জিজ্ঞাসুদের পাখি চিনতে, কোথায় কী কী দেখতে পাবেন সাহায্য করবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি পাখির নেশায় পড়েছি কিছুটা নিজের স্বার্থে। ভোরে স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশে রং-বেরঙের পাখি যা মন ও শরীরকে সজীব করে বা পেয়ে যাই কোনও দুর্লভ পাখির খোঁজ।

    Pradyut Choudhury

    নেওড়া নদীর উপত্যকা-কেই বলা নয় নেওড়া ভ্যালি। কালিম্পং থেকে লাভা মাত্র ৩২ কিমি দূরে অবস্থিত। আমরা শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং এসে পৌঁছলাম বেলা ১টায়। কালিম্পং-এ তাড়াতাড়ি একটি টিবেটিয়ান রেস্টুরেন্টে চিলি মাশরুম আর চিকেন ফ্রাইডরাইস দিয়ে খাবার সেরে রওনা দিলাম লাভার দিকে। সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম, বন ও উপত্যকা মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। রাজ্য সরকারের যে রিসর্টে আমরা থাকব সেটি লাভা পাহাড়ের ঠিক ওপরে।

    রিসর্টের চারিদিকে বড়বড় গাছের সারি, মাঝখানে অর্কিডের বাগান। ফুটে থাকা রঙ-বেরঙের অর্কিডের ওপরে প্রজাপতি ঘুরে বেড়াছে। তার মাঝে কটেজগুলি সাজানো, আমাদের কটেজের নাম গোর্খাওয়ান। বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখা যায় বহু দূরে নেওড়া ভ্যালির পাহাড়ের সারি। তাড়াতাড়ি কটেজে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা হাতে। রিসর্টের পাশেই একটি গাছের ডালে দেখলাম তিন-চারটে (Green-backed Tit) গ্রীন ব্যাক টিথ। পড়ন্ত রোদে ছোটাছুটি করছে তারা। কী তার রঙের বাহার। ইলেকট্রিক ওভারহেড তারে দেখলাম ট্রায়েগ্রা ফ্লাইক্যাচার ও ভারডিটার ফ্লাইক্ল্যাচার (Verditer Flycatcher) এর মধ্যে কিছু ছোট পাখি। হাতে সময় বেশি নেই কারণ সূর্য অস্ত যেতে আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। আমরা পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম পাহাড়ের পিছনে। কিছুটা এগোতেই এসে গেলাম ভ্যালির পাশে। একদিকে গভীর খাদ গাছে ঢাকা। দূরে পাহাড়ের সারি। খানিকটা এগোতেই পৌছলাম সুইসাইড পয়েন্টে। লোহার তার দিয়ে ঘেরা। হঠাৎই আমাদের সামনে ঘাসের উপর এসে বসল দুটি ছোট পাখি। এরা জোড়ায় থাকতে ভালোবাসে। পুরুষ পাখিটির  মাথায় সোনালি ছোপ লাগানো। নাম গোল্ডেন ন্যাপ ফ্রিঞ্চ(Golden-naped Finch)। এটা আমাদের একটি প্রাইজ ক্যাচ। পাহাড়ে  ঝুলন্ত জঙ্গল অন্য দিকে ভ্যালির খাদ নেমে গেছে। তার মাঝখানের রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। এখানের বেশিরভাগ পাখিগুলি খুব ছোট কিন্তু অপূর্ব রং। দেখা পেলাম গ্রে হেডেড ক্যানারি ফ্লাইক্যাচার (Grey-headed Canary Flycatcher), ফায়ার টেইল সানবার্ড( fire-tailed Sunbird), স্ট্রেটেড বুলবুল (Striated Bulbul), ভাডিটার ফ্লাইক্যাচার (Verditer Flycatcher), রেড ব্রেসটেড নচহ্যাচ (Red-breasted Nuthatch)। আসলে ঠান্ডায় পাখিরা  খুব চঞ্চল। একটা ফ্যানটাইল গাছের ডালের আপন মনে দোল খাচ্ছে। শেষ সূর্যের আলোয় একদল পাখি উড়ে চলেছে আকাশের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। আলো কমে এসেছে। অগত্যা আমরা রওয়ানা দিলাম। ঠাণ্ডা এখানে খুব বেশি অনুভব করা যাচ্ছে। ফেরার পথে লাভা বাজারে গরম গরম মোমো ও চায়ে চুমুক দিয়ে গা গরম করলাম। রিসোর্টে ফিরে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে সকাল সকাল উঠব বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    Black-throated Bush tits

     

    Blue-winged Minla

     

    golden neped finch(M)

    পরের দিন সকাল হতে না হতেই পাখিদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। কাঠঠোকরা (Red-breasted Nuthatch), এশিয়ান ব্রাউন ফ্লাইক্যাচার (asian brown flycatcher), Red-billed Leiothrix নানান রঙের প্রজাপতি তার মধ্যে ৩০-৩৫টি গ্রীন ব্যাকটিথ এ-গাছ ও-গাছে উড়ে বেড়াছে। চেসনাট ক্রাউন্ড লাফিং থ্রাস্ট(Chestnut crowned Laughingthrush)কে দেখলাম বাসাবাঁধার সরঞ্জাম যোগারে ব্যস্ত। কোনটি ছেড়ে কোনটির ছবি তুলব তা নিয়ে আমাদের মধ্যেও ছোটাছুটি পড়ে গেল। মনে হচ্ছিল পাখিগুলি যেন সকাল সকাল ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করাচ্ছে। যাই হোক সকাল ৯.৩০ পর্যন্ত একরকম ছোটাছুটি বন্ধ করে ব্রেকফাস্ট করতে বসলাম। রওনা হলাম নেওড়া ভ্যালির উদ্দেশ্যে।

    Gold-fronted Fulvetta

     

    Grey Headed Canary Flycatcher

     

    long tailed shrike

    লাভা এর আগে অনেকবার এসেছি। পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। লাভা থেকে মাত্র দশ কিমি হলেও এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে পৌছতে। কারণ খারাপ রাস্তা ও কুয়াশা। নেওড়া ভ্যালিতে আলোছায়া প্রতিনিয়ত খেলা করে। কখন পরিষ্কার আকাশ আবার কখনও মুহূর্তের মধ্যেই ঢেকে যায় কুয়াশায়। কুয়াশায় ফলে কখন মনে হয় ভ্যালিটি আকাশে ভাসমান। অপরূপ প্রাকৃতিক খেলায় আমরা, তখন হঠাৎ দুটো Satyr Tragopian দৌড়ে রাস্তাপার হল । গাড়ি থামিয়ে যেতে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশায় ঢাকা গভীর জঙ্গলে। স্মিতিচিহ্ন হিসাবে রয়েগেল গাড়ি থেকেই নেওয়া কয়েকটি আবছা ছবি। তবে নেওড়া ভ্যালির রাস্তায় দেখা পেয়েছি চেসনাট ক্রাউন্ড লাফিং থ্রাস্ট(Chestnut crowned Laughingthrush) ও Greater coucal আর ট্রাস-র মত বড় পাখিও।  এখানে অনেক পাখি দেখতে পাবেন কিন্তু ছবি তোলার আগেই অন্য ডালে।

    Green-backed Tit

     

    Red-billed Leiothrix

     

    Stripe-throated Yuhina

    নেওড়া ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক কালিম্পং জেলার অন্তর্গত। গরুমারা ন্যাশানাল পার্ক এর ছোট অংশ।  প্রায় ৩২০০ মিটার পাহাড়ের উপর রাচেলা পাস (Rachela Pass) সিকিমের সীমান্তের মিশেছে। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে দেখা মিলতে পারে লাল পান্ডারও। পাখির নেশায় এবার পৌছলাম গরুমারা ন্যাশানাল পার্ক। এখানে কড়া চেকিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জঙ্গলে ঘোরার জন্য গাইড । প্রায় একই দৃশ্য এখানেও, বড় বড় গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে । মাঝে মাঝে পাখিদের উঁকিঝুঁকি আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আলো আর দূরত্ব দুটোই এখানে ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাধা। দেখা পেলাম Black-throated Bush tits, Gold-fronted Fulvetta, chestnut crowned laughing Thrush, Stripe-throated Yuhina ও Variegated mountain টিকটিকও, যাকে আগে কখনো দেখিনি। ছবি তুলতে হলে অবশ্যই নেবেন ‘লং রিচিং টেলিল্যান্স’ অথবা তাড়াতাড়ি ফোকাস ও সাটারফেলতে পারে এমন ক্যামেরা। বেলা বাড়তেই আলো কমে যাচ্ছে। এবার আমরা চললাম ‘কোলাখাম’ এর দিকে।

    পাহাড়ের উপর অবস্থিত একটি শান্ত ও মনোরম গ্রাম কোলাখাম। আমাদের রিসর্টের নাম কোলাহামরি ট্রিট। একজন মহিলাই সব কিছু দেখাশুনা করেন। রিসর্টের জানালা দিয়ে দেখা মেলে নীচে উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য। লেমন টিতে চুমুক দিতে দিতে জানলা দিয়ে দেখছিলাম আস্তে আস্তে অন্ধকারের আড়ালেই মুছে যাচ্ছে পাহাড়গুলি। দূরে বরফে ঢাকা পর্বতশ্রেণী। কুয়াশার চাদর উঠে গেছে যেন দীপাবলির রাত, সমস্ত ভ্যালিতে ছোট ছোট আলো জ্বলছে। ভাবতে পারিনি এত গভীরেও মানুষ বসবাস করে। আকাশ দেখে মনে হয় আমরা তারামণ্ডলের ভেতরে বসে আছি। ধনুক হাতে কালপুরুষ আর সাত সিস্টারস জ্বলজ্বল করছে। আমাদের মত শহরবাসীদের কাছে এ এক অদ্ভুত পাওনা।

     

    chestnut crowned laughing thrush

     

    Oriental Turtle Dove

    গতকাল পরন্ত বিকালে কোলাহামে এসে একটা পাখির পিছনে অনেক দৌড়েছিলাম। যার নাম ব্লু হুসলিং থ্রাস (Blue  whistling Thrush)। কিন্তু কিছুতেই মনের মত করে ফ্রেমবন্দি করতে পারিনি। পরেরদিন ভোর হতে না হতেই সঙ্গী পাখি প্রেমিকবন্ধু আমাকে বলল, তোমার প্রিয় পাখি তোমাকে ডাকছে। প্রথমে ভাবলাম নিছক দুষ্টুমি। কিন্তু আধভাঙা ঘুম চোখে জানলা সমনে দাঁড়াতেই আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। দেখি, ব্লু হুসলিং থ্রাস (blue whistling Thrush)। পাখিটি খাবারের সন্ধানে আমাদের কর্টেজের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত কাছ থেকে এদের দেখা পাওয়া কঠিন। কারণ একটু শব্দ হলেই পালিয়ে যায়। এদিন সকালে খুব পরিষ্কার আকাশে নজরে এল একটি উড়ন্ত ক্রিস্টেড সারপেন্ট ঈগল(Crested Serpent Egale)। ক্ষীপ্রগতিতে লাভা পাহাড়ের গা থেকে উড়ে এল কোলাহামের দিকে। ক্রমশ ছোট থেকে বৃহৎ আকার নিল। আমিও একের পর এক শটে ফ্রেমবন্দি করলাম তার সম্পূর্ণ উড়ান। সকালে গ্রামের রাস্তার ধারে বাগানে দেখা পেলাম ওরিয়েন্টাল ট্রাটেল ডার্ভ(Oriental Turtle Dove), রোসেট স্পেরো (Russet Sparrow),জঙ্গল ক্রো(jungal Crow), ব্লু উইন্ড মিনলা(Blue-winged Minla), হিমালয়ান ফরেস্ট থ্রাস(Himalayan forest thrush), লং টেইল স্রাইকা(long-taied Shrike), গ্রে বুসচার্ট(Grey Bushchat), স্ট্রিয়াটেড বুলবুল (Striated Bulbul)।

    fire-tailed Sunbird
    Blue whistling thrush

     

    Verditer Flycatcher

    শান্ত গ্রামের মাঝে পাখি দেখতে দেখতে আমাদের দিনগুলি যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। শহর থেক দূরে শান্ত মনোরম পরিবেশে পাখিদের ব্যস্ততা, কুয়াশার আবছাওয়ার গল্প, আকাশ ভরা তারা সবই যেন দাগ কেটে যায় মনে। উড়িয়ে নিয়ে যায় দূরদূরান্তে। ছবি আঁকে স্মৃতিপটে, যা পরবর্তি ব্যস্ত জীবনে দেয় স্নিগ্ধতা। আসলে ঘুরে এসে ব্যস্ত কর্মজীবনে যখনই আমি চোখ বন্ধ করি তখন জেগে উঠে সেইসব ছবিগুলি। অফিসের চেয়ারে বসেই উড়ে যাই পাখিদের দেশে নেওড়া ভ্যালিতে।

    Red-breasted Nuthatch

     

    striated bulbul

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @