শুধু শরীর না, নিয়মিত যোগাভ্যাস মনও ভালো রাখে

আজকাল আমাদের মধ্যে যোগাভ্যাসের চল বেড়েছে। যদিও অনেকেই মনে করেন যোগ মানে শুধুই শারীরিক কসরৎ, যেখানে জটিল পদ্ধতিতে শরীরটাকে মুচড়িয়ে, ঘুরিয়ে, টেনে ফেলতে হয় এবং সঙ্গে থাকে কিছু কঠিন শ্বাসের ক্রিয়া। কিন্তু অনেকেই জানেন না সেটার সঙ্গে প্রকৃত যোগের কোনোরকম সম্পর্ক নেই। যোগ আরও গভীর এবং বৃহৎ বিষয়। খুব সাধারণভাবে বলা যায়, আপনার প্রতিদিনের জীবনযাপনে যে নিয়ম, সেটি শুদ্ধ ও সঠিকভাবে পালন করাকে যোগ বলে। যোগ একটি সঠিক পরিপূর্ণ জীবনযাত্রা। আসলে এই যোগবিজ্ঞানের মধ্যে জীবনকে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে কীকরে কাটানো যায়, সেই কথাই বলা আছে। যোগ শুধুমাত্র আসন নয়, শরীর এবং মন এই দুইয়ের মিলনস্থলে ভারসাম্য তৈরি করার এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
বর্তমান যুগে আমরা সবাই ভীষণ ব্যস্ত। পয়সা রোজগারের পেছনে ছুটতে ছুটতে অজান্তেই নিজেদের মন এবং শরীরকে অবহেলা করে চলেছি রোজ। আমরা ভুলে যাচ্ছি এই শরীর না থাকলে সবকিছুই অসম্ভব, আবার মন ঠিক না থাকলে শরীরও যে অসুস্থ হয়ে পড়বে বারবার। বেশিরভাগ মানুষ আবার শুধু শরীরকে ফিট রাখতে গিয়ে হয় ডায়েট করছেন কিংবা জিমে গিয়ে ওয়েট ট্রেনিং করছেন। তাতে কিছু মাত্রায় শরীরের বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটছে ঠিকই। কিন্তু যোগাভ্যাসের মধ্যে দিয়ে শুধু শরীরই নয় মনকেও ভালো রাখা যায়। এমনটাই বলছে যোগের ইতিহাস। কিন্তু কোথা থেকে এই যোগের উৎপত্তি হয়েছিল সে বিষয়ে অনেকেরই কোনও ধারণা নেই।
আমাদের ভারতবর্ষ হল যোগের উৎসস্থল। সংস্কৃত শব্দ ‘যুজ’ থেকে আসা ‘যোগ’ শব্দের অর্থ হল ব্যক্তিসত্ত্বার সঙ্গে বিশ্ব সত্ত্বার মিলন। যোগের জ্ঞান প্রায় ৫,০০০ বছরের পুরোনো। কথিত আছে, শিব প্রথম প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী পার্বতীকে। দ্বিতীয় দফার যোগ শিক্ষা দান করেন তাঁর প্রথম সাতজন শিষ্যকে। সেটা ঘটেছিল নাকি কেদারনাথের কান্তি সরোবরের তীরে। এখানেই বিশ্বের প্রথম যোগ শিক্ষার বিশাল আয়োজন করা হয়েছিলো। বহু বছর পর, যখন যোগ শাস্ত্রের জ্ঞান দান সম্পূর্ণ, তখন উদ্ভব হয় সাতজন ঋষির যাঁরা সপ্তঋষি নামে পরিচিত। শিব এই সাতজনের প্রত্যেককে যোগশাস্ত্রের একটি করে দিক প্রদান করেন আর এই সাতটি দিক যোগের মূল সাতটি ধারা হয়ে যায়। যোগ সাধনার একটি অন্যতম ভালো দিক হল, যে কোনো বয়সের সুস্থ অথবা দুর্বল ব্যক্তি এই সাধনাকে জীবনের অঙ্গ করতে পারেন। প্রতিদিন বিভিন্ন আসন চর্চার মধ্যে দিয়ে অভ্যাসকারীদের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা দীর্ঘস্থায়ী পুরোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু আচরণগত পরিবর্তনও তাঁদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই মনে আনন্দ অনুভব করছে, উৎকণ্ঠা কমে গেছে, ধৈর্যের মাত্রা বেড়েছে, মনের বিচার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এগুলো কি সত্যিই সম্ভব? নিশ্চয়। কীভাবে?
বেশিরভাগ মানুষ আবার শুধু শরীরকে ফিট রাখতে গিয়ে হয় ডায়েট করছেন কিংবা জিমে গিয়ে ওয়েট ট্রেনিং করছেন। তাতে কিছু মাত্রায় শরীরের বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটছে ঠিকই। কিন্তু যোগাভ্যাসের মধ্যে দিয়ে শুধু শরীরই নয় মনকেও ভালো রাখা যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে প্রকৃত এবং শুদ্ধ পদ্ধতিতে যোগাভ্যাস (Yoga Practice) করার ফলস্বরূপ জীবনে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব। আজকাল বাজারে প্রচুর বই বিক্রি হয়। ৭ দিনে যোগা শিখুন, কিংবা যোগা দিয়ে রোগমুক্তির উপায়। এই বইগুলোর প্রভাব মানবজীবনে ভীষণভাবে ক্ষতিকারক। এই সব বই পড়ে কতগুলো আসনের ভঙ্গি শিখে ফেলা যাবে ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণ না একজন শিক্ষিত যোগীর কাছে গিয়ে আপনি যোগ শিখছেন, ততক্ষণ যোগচর্চার সূক্ষ্মতম দিকগুলো আপনার কাছে অধরা রয়ে যাবে। যোগ কখনোই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনও বিষয় নয়। একটু ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করলে বুঝতে পারবেন আমরা যখন মায়ের পেটের মধ্যে থাকি, তখন যেভাবে কুঁকড়ে থাকি, সেটাও যোগের ভাষায় একটি আসন। একে চাইল্ড পোজ বা বালাসন বলা হয়। সাধারণত যোগাভ্যাসের সময় রিল্যাক্স করার জন্যে এই আসনটি করা হয়। জন্মের আগে থেকেই আমরা কিন্তু যোগের মধ্যে থাকি। এরপর সশরীরে মায়ের শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পর আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্যে দিয়েই অনেক রকম ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আসনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। এছাড়াও বিভিন্ন পশুদের চলাফেরার ভঙ্গী থেকেও যোগের বিভিন্ন আসন এসেছে। যেমন সাপ থেকে ভুজঙ্গাসন, পায়রা থেকে কপতাসন, বিছে থেকে বৃশ্চিকাসন। ফলে যোগা হল এমন একটি বিষয়, যেটা ভীষণভাবে জৈব।
তবে এই সাধনা করতে গেলে সবথেকে বেশি প্রয়োজন মনঃসংযোগ এবং ধারাবাহিকতা। আর দরকার নিজের ওপরে বিশ্বাস। যোগের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন রকমের রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি। তবে একটা ভুল ধারণা হল যোগাভ্যাস আমাদের জটিল রোগ সারিয়ে দিতে পারে। যেকোনো জটিল রোগের প্রথমে সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। যোগের মাধ্যমে আমরা আজীবন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকতে পারব। তাই খুব ছোটো বয়স থেকেই যদি এই চর্চা শুরু করা যায়, আমরা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অনেক বেশি করে ভালো থাকব।
আমরা এখন প্রায়শই একটা শব্দ শুনতে পাই , সেটা হল লাইফস্টাইল ডিজিস। আর যোগসাধনা একজন মানুষের জীবন কাটানোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে। কীভাবে? পতঞ্জলি যোগসূত্র অনুযায়ী মূল যোগের আটটি শাখা বা ধাপ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ইয়াম, নিয়ম, ধ্যান, ধারণা, প্রত্যাহার, প্রাণায়াম, আসন ও সমাধি। এই আটটি বিষয় যখন আপনার জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পূর্ণ যুক্ত করে নেওয়া যাবে, তখনই পুরোপুরি যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারা যাবে। এই আটটি ধাপের মধ্যে একটি ধাপ হল আসন। এই আসনই হল শারীরিক ব্যায়ামচর্চা। এমন অনেক আসন আছে যেগুলি নিয়মিত চর্চা করলে কোমরে ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, পিঠের ব্যথা, অথবা ঠান্ডা লাগার সমস্যা থেকে শুরু করে হজম এবং কনস্টিপেশনের সমস্যা থেকেও খানিকটা রেহাই পাওয়া যায়। হ্যাঁ, অবশ্যই এটা মাথায় রাখতে হবে কোনও রোগ নির্মূল করা যোগের কাজ নয়। শুধু মানবশরীরে সেই রোগের প্রভাব আরও যাতে বেড়ে না যায় সেটাই যোগার কাজ।
৭ দিনে যোগা শিখুন, কিংবা যোগা দিয়ে রোগমুক্তির উপায়। এই বইগুলোর প্রভাব মানবজীবনে ভীষণভাবে ক্ষতিকারক। যতক্ষণ না একজন শিক্ষিত যোগীর কাছে গিয়ে আপনি যোগ শিখছেন, ততক্ষণ যোগচর্চার সূক্ষ্মতম দিকগুলো আপনার কাছে অধরা রয়ে যাবে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাণায়াম। মূলত শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ামকেই প্রাণায়াম বলা হয়। নিজের মনকে স্থির করে শ্বাস প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করার চর্চা যেমন ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, তেমনি মানসিকভাবে নিজেকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাঁরা অল্প ঠান্ডাতেই বেশি রোগাক্রান্ত হন। এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যাঁদের মানসিক পরিবর্তন ঘটে, তাঁদের জন্য প্রাণায়াম খুবই কার্যকর। শীতে শরীর উষ্ণ রাখতে, গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে, শ্বাসকষ্ট দূর করতে, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে প্রাণায়াম ভীষণ ভাবে সাহায্য করে। এরপরে আসে কিছু ক্রিয়া, যা আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে সচল রাখে। কিছু ক্রিয়া আছে বিশেষ করে যাঁরা মাইগ্রেন ও সাইনাসের সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের জন্য ক্রিয়া খুবই জরুরি। ক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে কপাল ভাতি (কপালিভাতি ক্রিয়া হলেও এটাকে অনেকে প্রাণায়াম হিসেবেই করে থাকেন), অগ্নিসার, জল নেতি, সূত্র নেতি, বমনধৌতি ইত্যাদি।
বর্তমানে নানা কারণে আমরা অনেক বেশি বিষণ্ণ থাকি। কাজে মন না বসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশনেও ভোগেন অনেকে। এসব সমস্যা থেকে আপনি মুক্তি পেতে পারেন মেডিটেশনের মাধ্যমে। তাই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন এবং চেষ্টা করুন সঠিক নিয়মে মেডিটেশন করার। সবশেষে আবারও একটি সতর্কবার্তা, যখন যোগচর্চা করার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন অবশ্যই কোনো সঠিক গুরুর কাছে প্রথমে নিজের শারীরিক সমস্যার কথা জানাবেন। তারপর যে আসন, প্রাণায়াম, ক্রিয়া ও মেডিটেশন আপনার স্বাস্থ্যের উপযোগী, শুধু সেগুলোই করবেন। এ ছাড়া যেকোনো যোগাসনে যাওয়ার আগে অবশ্যই শরীরকে ওয়ার্মআপ করে নেবেন। শরীরের জং না ছাড়ালে হঠাৎ ব্যথা পাওয়া-সহ নানা সমস্যা হতে পারে। ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। আন্তর্জাতিক যোগ দিবস (International Yoga Day)-এ যোগ চর্চার মাধ্যমেই না হয় জীবনে আসুক নতুন সকাল। শুরু হোক এক নতুন অধ্যায়।
_______
ছবি: মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি