দেবদেবী নয়, বাঙালি ব্যক্তিত্ব সেজে ঘরে ঘরে হাজির হন আউসগ্রামের বহুরূপী নিতাই পাল

একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বহুরূপীদের দেখা মিলত। বাংলার প্রাচীন লোক সংস্কৃতিগুলির মধ্যে বহুরূপী অন্যতম। এই শিল্পকর্মকে লোকনাট্যের মধ্যেই ধরা হয়ে থাকে। পূর্ব বর্ধমান জেলায় এখন একমাত্র একটি গ্রামেই নিয়মিত বহুরূপী দেখা যায়। সেই গ্রামের নাম ভুয়েড়া, যা আউসগ্রাম থানা-র অন্তর্গত। বর্ধমান শহরের নবাবহাট থেকে ভায়া সিউড়ির বাস ধরে নামতে হবে ‘ছোড়া’ নামের এক বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে আবার সাইকেল বা মোটরসাইকেল মারফৎ ভুয়েড়া গ্রামে যেতে হয়। এই গ্রামেরই এক শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে বহুরূপী শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিনি একাই ভিন্নসাজে বহুরূপী সেজে মানুষদের আনন্দদান করছেন। নিতাই পাল – তবে এটাই তাঁর সম্পূর্ণ পেশা নয়। পেশায় তিনি বংশগতভাবে একজন কুম্ভকার। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার জায়গা বহুরূপী শিল্প। তিনি কীভাবে বহুরূপী শিল্পকে ভালোবেসে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে মনোরঞ্জন করে যাচ্ছেন সেই ইতিহাসে যাবার আগে ‘বহুরূপী’ বিষয়ে সামান্য কিছু বলা যাক।
পূর্ব বর্ধমান জেলার ভুয়েড়া গ্রামে নিতাই চন্দ্র পাল দীর্ঘ বছর ধরে বহুরূপী সেজে যে মনোরঞ্জন করে যাচ্ছেন, তাঁর সেই কাজকে যথাযথভাবে সম্মান করা কর্তব্য।
‘বহুরূপী’ শব্দের মধ্যে রয়েছে দুটি শব্দ। দুই শব্দই সংস্কৃত শব্দ থেকে আগত। ‘বহু’ শব্দে অনেক, ‘রূপী’ শব্দে রূপধারণ করার অর্থ বোঝায়। অর্থাৎ যাঁরা এক দেহে অনেক রূপ ধারণ করে একটি শিল্পকে ফুটিয়ে তুলে আনন্দদান করতে পারেন তাঁদেরকেই বহুরূপী নামে আখ্যায়িত করা হয়। একটা সময়ে এই শিল্পকেই পেশাগতভাবে বেছে নিতে দেখা যেত। কারণ মানুষের কাছে তখনও এই শিল্পের কদর ছিল। রাস্তা ঘাটে, বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে বহুরূপীর দেখা মিলত। প্রতিদিন অন্য অন্য রূপ ধারণ করাই বহুরূপীদের কাজ ছিল। কখনও দেবদেবীর রূপ, কখনও অসুর বা মহাপুরুষদের রূপ ধারণ করে এসে বিভিন্ন দৈহিক অঙ্গভঙ্গি ও মুখে উচ্চারণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষদের মাঝে নাট্যভঙ্গিতে তাঁদের শিল্পকলা প্রদর্শন করতেন। তাঁদের পোশাক হয় বিভিন্ন রংচঙে, মুখে লাগানো থাকে কৃত্রিম রং, হাতে চরিত্রানুযায়ী থাকে নকল অস্ত্র। কখনও ছেলে, কখনও মেয়ে, আবার কখনও বৃদ্ধ সেজে সেই চরিত্রের গলার নকল, চলাফেরার ধরন এমন দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা বহুরূপীদের মধ্যে দেখা যেত, যার ফলে বোঝা মুশকিল তাঁরা কেউ থিয়েটারের অভিনেতা নন।
আরও পড়ুন: বহুরূপীর অন্দর-কথা
এই বহুরূপীর চল এতটাই ছিল যে, বাংলার অনেক সাহিত্যে (সুবোধ ঘোষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্প, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’-তে ছিনাথ বহুরূপী ইত্যাদি); অনেক চলচ্চিত্রে (‘সুবর্ণরেখা’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’, ‘মন মানে না’ ইত্যাদি) দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু বর্তমানে সেই বহুরূপীর সংখ্যা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই পেশায় অংশ নিতে আর তেমনভাবে কাউকেই দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ অবশ্যই আধুনিক জীবনযাত্রা এবং এই নাট্যশিল্পকে গুরুত্ব না দেওয়া। তবুও পূর্ব বর্ধমান জেলার ভুয়েড়া গ্রামে নিতাই চন্দ্র পাল দীর্ঘ বছর ধরে বহুরূপী সেজে যে মনোরঞ্জন করে যাচ্ছেন, তাঁর সেই কাজকে যথাযথভাবে সম্মান করা কর্তব্য।
নিতাই পাল কীভাবে এই নাট্যশিল্পে প্রবেশ করলেন সেই বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গদর্শন.কম-কে তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামে বহুকাল ধরেই যাত্রা হয়। এখনও হয় ধর্মরাজ পাড়াতে একখানা স্থায়ী মঞ্চে। সেই যাত্রাতে পাড়ার এক দাদু শিল্পীদের মেকআপ করে দিতেন। ছোটোবেলা থেকেই দাদুর মেকআপ করা দেখতাম। দাদুও মাঝে মাঝে আমাকে দিয়ে ছোটো ছোটো মেকআপ করিয়ে নিতেন।” তারপর একদিন দাদু যখন বয়সজনিত কারণে আর পারলেন না, মেকআপের সেই তুলি তুলে দিলেন নিতাই পালের হাতে। নিতাই পাল হয়ে উঠলেন একজন দক্ষ মেকআপ আর্টিস্ট। সাজার প্রতি ভালোবাসাও জন্মাল। একসময় নিজেই শুরু করলেন সাজতে। হয়ে উঠলেন বহুরূপী।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার লোকশিল্পীদের জন্য ভাতা দেয়, নিতাই পালও সেই ভাতা পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বছর পাঁচেক আগে। তাই এখন বেশিরভাগ সময় সরকারি উদ্যোগে কোনো আমন্ত্রিত মঞ্চে তিনি উপস্থিত হন বিভিন্ন রূপে।
তবে বহুরূপী বলতে আমাদের চোখে যে পৌরাণিক দেবদেবী, রাক্ষস-খোক্ষসের রূপ ধারণ করা ছবি ফুটে ওঠে, নিতাই পাল কিন্তু সেই বহুরূপী সাজেন না। তিনি চেয়েছিলেন মানুষ বহুরূপীর এক জিনিস দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তাই চরিত্র বেছে নেবেন ঋষি, কবিদের মতো মানুষদের। নিতাই পালকে বহুরূপীর সাজে দেখা যায় কখনও গয়ার পাণ্ডা রূপে, কখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, আবার কখনও নেতাজি রূপে। প্রথম প্রথম এই সাজে তিনি গ্রামে গ্রামে যেতেন। মহাপুরুষদের হাঁটাচলা, বাণী নকল করে করে বলতেন। মানুষ নতুন স্বাদ পেলেন। তবে এখন আর গ্রামে গ্রামে যান না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার লোকশিল্পীদের জন্য ভাতা দেয়, নিতাই পালও সেই ভাতা পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বছর পাঁচেক আগে। তাই এখন বেশিরভাগ সময় সরকারি উদ্যোগে কোনো আমন্ত্রিত মঞ্চে তিনি উপস্থিত হন বিভিন্ন রূপে।
বর্তমানে মোবাইল, ইন্টারনেটের দাপটে বহুরূপী শিল্পের অবস্থান কোথায় দাঁড়িয়ে, শিল্পীরা কী ভাবছেন সেই বিষয়ে জানতে চাইলে নিতাই পাল বলেন, “মানুষ আর এই শিল্পকে গুরুত্ব দেয় না। এখন হাতের মুঠোয় এত বিনোদন দেখতে পাওয়া যায় যে, বহুরূপী সেজে যে পরিশ্রম শিল্পীদের হয় তার একাংশও মুনাফা হয় না।” সম্প্রতি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখার্জি পরিচালিত ‘বহুরূপী’ ছবিতে এমনই একজন শিল্পীর উপস্থিতি নজর কেড়েছে বঙ্গবাসীর। বীরভূম নিবাসী ননীচোরা দাস বাউল। ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। বছরের অন্যতম সুপারহিট এই ছবির দৌলতে বহুদিন পর আবার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে ছোটোবেলায় দেখা বহুরূপীদের স্মৃতি। এখন বহুরূপীদের ভবিষ্যৎ কোথায়, তার উত্তর দেবে সময়।