No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    উত্তমের গলায় কেওড়াতলা শ্মশানের মালা পরিয়ে শুট করা হল ‘তুমি যে আমার’

    উত্তমের গলায় কেওড়াতলা শ্মশানের মালা পরিয়ে শুট করা হল ‘তুমি যে আমার’

    Story image

    নব্বইয়ের শিশু। জন্মেই জীবন দেখছে। দেখছে আলগোছে বাঁচছে সবাই। ভালোবাসছে। আটপৌরে চোখগুলোতে অবকাশের উদাসীন সুর। একটু সময় পেলেই আড় ভেঙে বেঁচে উঠছে। দিনরাতের ওঠাপড়া ছবি-গান-হুল্লোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বড়োলোকি চালকে হেলায় তাচ্ছিল্য করছে উঠতি-গোঁফের দল। ফি রোববার পাড়া-বেপাড়া দিয়ে কাঁচা সৈনিক টহল দিচ্ছে সাইকেলে। রোদ-জল মেখে বাড়ি ফিরেই কলঘরে। তাড়াহুড়োয় পরিপাটি করে টেরি কাটা চুল থেকে জল ঝরে পড়ছে মাংসের ঝোলের বাটিতে। পেটে খেলে পিঠে সয়। গ্লোবালাইজেশন একবার করে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মোড়ের এগরোলের কর্নারটা থেকে। কদিন আগেও মাংসের ঘুগনিটা জুটছিল। একদিন বিকেলে খেলতে যাওয়ার আগে চোখ আটকে গেছে দূরদর্শনে। ডিডি বাংলা। ‘রবিবারের ছায়াছবি’।

    একটা স্নিগ্ধ মুখ। ঘোমটা টানা মাথায় একটা বড়ো দরজা ঠেলে করিডরে বেরিয়ে এল। কপালে একটা ছোটো টিপ। পলাশপুর থেকে রমা এসেছে কলকাতায়। কিন্তু দুটো চোখই কষ্ট পাচ্ছে। আর অনেকটা মায়া বুনছে। অলোক তাকে চিনতেই পারলো না! বয়স হয়ে যাওয়া সাদা-কালো টিভিটা ঝিলঝিল করে উঠলো। যৌথ পরিবারগুলো গ্লোবালইজড হতে হতেও রূপোলি বাঙালি পর্দায় থেমে রইলো। অনন্তকাল। আর সেই শিশু আজ ফ্রিজ শট থেকে মধ্য যৌবনে এসে খুঁজে পেয়েছে বাংলা ম্যাটিনির নিখাদ শিল্পগুণ।অজয় কর চল্লিশের মাঝামাঝি থেকেই আছেন। টকিজ দেখেছেন। ট্যাবল্যু। মনে ধরেনি। যেন নাটকের স্টেজ। কেমন কাঠকাঠ সবাই! আসছে আর চলে যাচ্ছে। ক্যামেরাটা ফিক্সড। তবে একটা বদল আসছে। সেই ‘মুক্তি’ থেকেই প্রমথেশ বড়ুয়া ভাঙছেন। সবচেয়ে স্পষ্ট মনে আছে ‘উদয়ের পথে’। চাষারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ফ্যান ভিক্ষা করছে। এমন দুর্ভিক্ষ ওই বিমল বাবুই প্রথম দেখালেন। অজয় ছিলেন ক্যামেরা নিয়েই। তবে নিয়মিত হলিউড দেখছেন। ক্লাসিক্যাল হলিউড। গল্প যে দু-একটা মনে ধরেনি তা নয়। ওরাও তো দিব্যি অ্যাডাপ্ট করছে। কনান ডয়েলের ‘হাউনড অফ দি বাস্কারভিলস’ আগেই অ্যাডাপ্ট করেছে সিডনি ল্যানফিল্ড। অজয় দেখেছেন সে ছবি। ভেবেছেন। বাংলায় করলে কেমন হয়? আগে কেউ করেনি! আর গল্পটাও খুব ভালো। নতুন ঠাট। ঠাসা বুনন। কাস্টিংটা ঠিক হলেই জমে যাবে।

    বিকাশ রায়কে মাথায় রেখেছেন রজার বাস্কারভিলস ওরফে স্টেপল্‌টনের জন্য। হোমস আরেকটু দেখতে হবে। তার আগে চিত্রনাট্যের আরেকটা খসড়া করতে হবে। ডারটমুরের প্লটে বাংলার গল্প বলবেন অজয়। এদিক-ওদিক হবে অনেক। আচ্ছা, ‘মেট্রো’ সিনেমার গেটকিপারটাকে বেশ ভাড়াটে গুন্ডার মতো দেখতে না? অজয়ের মনে পড়লো। বিদেশি ছবি দেখতে প্রায়ই ‘মেট্রো’-তে যান অজয়। স্যার হেনরিকে মারার লোক পাওয়া গেল তবে! খসড়ার পর খসড়া পালটে, নাম-মুখ ওলটপালট করে অজয় তাঁর প্রথম ফিচারেই বিপ্লব আনলেন। ১৯৫১-র ‘জিঘাংসা’ একটা মাইলফলক।একটা রোম্যান্টিক ট্রেনড বোধহয় আসছে। আসবেই। রোজনামচার উপর রূপোলি আলো পড়েছে। কলকাতার মেসবাড়িগুলো রাতারাতি নাম কিনে নিয়েছে। কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যাওয়া শিক্ষিত বেকাররা রাতের তক্তাপোষের এক কোনে বসে প্রেমপত্র লিখছে। মাসখানেক আগে কলেজে ভর্তি হওয়া অষ্টাদশীরা ঠা ঠা রোদে ছাতা ঘুরিয়ে দুটো চক্কর মেরে আসছে। আসলে হালে নির্মল দে একটা ভালো জুটির খোঁজ দিয়েছেন। তাই বাসে-ট্রামে লোকের চোখ মজে গেছে। লঘু মেজাজের শহুরে প্রেম পরিবারের সম্মতিতেই পরিণতি পাচ্ছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বেশ মনে ধরেছে অজয়ের। উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে কাজ করা যায়! একটা গল্প মাথায় আছে বটে। হলিউডেরই গল্প। বেশ কয়েক বছর আগে ‘মেট্রো’তে ‘র‍্যানডম হারভেসট’ দেখেছিলেন অজয় কর। তারও বছর তিনেক পরে ‘স্পেলবাউনড’। একইরকম প্লট। তখন থেকেই মাথায় ছিল গল্পটা। শুধু দু-তিনটে গান চাই। বাংলা গান। আর প্রেমটা উচ্চবিত্তর মধ্যেই থাক। শুধু একটু বাঙালি করে নিতে হবে। চেনা ছকের নিশ্চিন্ত মেজাজ।নৃপেনবাবু চমৎকার চিত্রনাট্য লিখেছেন। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। তবে চিন্তা গানদুটো নিয়ে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছেন গানদুটো। একটু অন্যরকম ধাঁচে শুট করার কথা ভেবেছেন অজয়। নায়ক-নায়িকার চোখ-মুখের  মায়া ছড়িয়ে দিতে হবে পর্দায়। ক্যামেরাটাও তার হাতেই আছে। একটা গানের প্লেব্যাক শুনেছেন অজয়। গীতা দত্ত গেয়েছেন। ‘তুমি যে আমার’। যা ভেবেছেন তাই! বাঙালি মেজাজ ষোলোআনা রয়েছে। সেইমতো ভেবেচিন্তে নিউ থিয়েটার্সেই সেট ফেলা হয়েছে। টালিগঞ্জে। ‘পলাশপুর’-এর আউটডোর পোষাবে না। অনেকগুলো লং টেক রয়েছে। কিন্তু শুটের আগেই বিপত্তি! দুটো মালা আনতে বলা হয়েছিল। রজনীগন্ধার মালা। নায়ক-নায়িকার গলায় থাকবে। কিন্তু মোটে একটাই মালা পাওয়া গেছে। এদিকে মিসেস সেন মালা না পেলে রাগারাগি করবেন। উত্তমের গলায় থাকলে তাঁর গলাতেও দিতে হবে। কিন্তু উত্তমই বা কী ভাববে! কী করা যায়?

    একজনকে পাঠালেন মালার খোঁজে। কাছেপিঠে বাজারও নেই, সেই লেক মার্কেট। এদিকে আবার একটাই বাস চলে, ৬ নম্বর। চিন্তায় পড়লেন পরিচালক অজয় কর। যাক, একটু পরেই মালা এল। কিন্তু এ তো কেওড়াতলা মহাশ্মশানের! সর্বনাশ! কেউ টের পেলে আর রক্ষে নেই! মুখে কুলুপ আঁটলেন পরিচালক। আজকে শুট করতেই হবে। যেমন করেই হোক। উত্তমের গলায় চড়লো সেই শ্মশানের মালা। কেউ জানলো না। কেউ বুঝলো না। অজয় চোখ রাখলেন ক্যামেরায়।

    সব মিলিয়ে দশটা শট। দু-একটা বাদে সবই লং টেক। ইচ্ছে করেই শট ধরে রেখেছেন অজয়। ধরে রেখেছেন ম্যাটিনি মায়া। কেউ উঠে যাবে না। কেউ বিরক্ত হবে না। এবার খেলা জমবে। শুধু উত্তম-সুচিত্রা মাঝে মাঝে মিড-ক্লোজ থেকে ক্লোজে আসছেন। আবার লং শটে উন্মুক্ত প্রকৃতি। না, ছাড়াছাড়া লাগছে না। বরং বুনোট ধরে রাখছে চোখ-মুখ-গান। ক্যামেরায় লেন্সে হারিয়ে যেতে যেতে অজয় ভুলে গেলেন কেওড়াতলার মালা। একবার ফ্ল্যাশ হল গ্রেটা গার্বোর সফট ফোকাস। এমজিএম জলজ্যান্ত ভেনাসকে এনেছিল পর্দায়। না, এ হলিউড নয়। আদ্যন্ত রমা ব্যানার্জি। ভালোবাসার কাঙাল বাঙালি বধূ। খুঁজে ফিরছেন মাথা ভুলে হারিয়ে যাওয়া অপ্রতিভ স্বামীটিকে। শহর কলকাতার অফিস ফেরতা ড্রয়িং রুম থেকে ট্রেন ধরে পলাশপুর। আজও।

    তথ্যসূত্রঃ

    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    (চলচ্চিত্র বিশারদ এবং প্রাক্তন অধ্যাপক, চলচ্চিত্রবিদ্যা-যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @