স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান ছিলেন এই সপ্তদশী বাঙালি

পুরুষশাসিত সমাজ। তাই এই সমাজে মহিলা অ্যাথলেটিকসদের নাম উচ্চারিত হয় খুব কম। এই লেখার প্রাণকেন্দ্রে যে মহিলার নাম রয়েছে, তাঁর নামও হাতে গোনা গুটি কয়েক বাঙালি হয়তো শুনেছেন। মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয় দিয়ে শুরু হয়ে হয়েছিল বাঙালির ফুটবলের প্রতি নতুন আবেগ, উন্মাদনা, ভালোবাসা। ব্রিটিশদের ‘দেখিয়ে’ দেওয়ার উজ্জ্বল ছবি। মাঠের ভার তাই পুরুষদের হাতেই। মহিলারা মাঠে নামলে এখনও হয়তো তাঁদের শুনতে হয়, “মেয়ে হয়ে আবার খেলার মাঠ! ক্রিকেট! ফুটবল! হাস্যকর!” এসব টোন-টিটকিরির মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বাঙালি মহিলা খেলোয়াড়। তাঁদের মধ্যেই একজন নীলিমা ঘোষ।
ভারত সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। দেশ তো বটেই, বাংলার বুকেও তখন ধিকিধিকি স্বপ্নের নয়া মোড় তৈরি হচ্ছে। একদল যুবক-যুবতীর চোখে উচ্ছ্বাসের আলো। তাঁরা স্বাধীন। ঠিক এই সময় খেলার মাঠেও নতুন হাওয়া আনলেন বাংলার নীলিমা। তৈরি হল নারী স্বাধীনতার নতুন যুগ। নীলিমার বয়স তখন সতেরো। রক্ষণশীল পুরুষশাসিত বাঙালি সমাজকে তুড়ি মেরে নীলিমা পৌঁছে গেলেন অলিম্পিক্সের স্প্রিন্টে। দেশের মহিলা ট্র্যাক ইভেন্টে অংশ নেওয়া প্রথম অলিম্পিয়ান। ১৯৫২ সালে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে বসেছিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর।
নীলিমা ঘোষের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন। বাঙালির মনে তখন শুধুই ফুটবল আর ফুটবল। মেয়েদের ইচ্ছা করলেও উপায় ছিল না খেলার মাঠে পা রাখার। ছোটো পোশাকেও আপত্তি ছিল প্রায় সকলের। সার্কাস বা জিমন্যাস্টিকে গুটিকয়েক মেয়েদের দেখা গেলেও অন্যান্য খেলায় নৈব নৈব চ। সাতচল্লিশের দেশভাগ যুবক-যুবতীদের স্বপ্ন ভেঙেচুরে দিল। বিশেষ করে মেয়েদের জীবনে গ্রাস করল অন্ধকার। ঘর আর বাহিরের চাপা দ্বন্দ্ব। তেমনই এক গুমোট পরিবেশে চলত নীলিমার প্রশিক্ষণ। দেশ স্বাধীনের ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্সের হেলসিঙ্কিতে ডাক পড়ল নীলিমার।
নীলিমা অংশ নিয়েছিলেন দুটি ইভেন্টে। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ও ৮০ মিটার হার্ডল। ১০০ মিটারের প্রথম রাউন্ডের প্রথম হিটেই ট্র্যাকে প্রথম স্বাধীন ভারতীয় মহিলা হিসেবে পা রাখেন নীলিমা। ফলাফল?
তৃতীয় স্থানাধিকারি আর্জেন্টিনার লিলিয়ান হেইনজের থেকে ০.১ সেকেন্ড পরে শেষ করলেন নীলিমা। ১৩.৬ সেকেন্ড। অন্যদিকে ৮০ মিটার হার্ডলে তিনি শেষ করলেন হিটের বিজয়িনীর চেয়ে ২ সেকেন্ড পরে। চ্যাম্পিয়ন হয়তো সেদিন হতে পারেননি নীলিমা। কিন্তু তাঁর মতো অসংখ্য মহিলার স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পেরেছিলেন। ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান। তাও আবার বাঙালি।
অলিম্পিক্সে তারপর ইতিহাস গড়েছেন বহু ভারতীয় মহিলা। পিটি ঊষা থেকে চিত্রা সোমান, পিভি সিন্ধু থেকে লভলিনা বরগোহাঁই কিংবা মীরাবাঈ চানু অনেকেই ভারতকে গর্বিত করেছেন। কিন্তু যিনি এই পথ দেখালেন, সেই নীলিমা ঘোষ থেকে যাবেন আমাদের অন্তরে। ভারত তথা বাঙালি নারীসমাজ নীলিমাকে সেদিন বসিয়েছিল ‘আইকন’-এর আসনে। এক নিমেষে ঘুচে গিয়েছিল ‘মেয়ে’ হবার জ্বালা। পুরুষশাসিত সমাজের পুরুষরা সেদিন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি সেই মেয়েকে আজ ক’জনই বা মনে রেখেছেন!