No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বীরবাহা, জ্যোৎস্না, সন্ধ্যারানি – নতুন মন্ত্রীসভায় জঙ্গলমহলের তিন আদিবাসী কন্যা 

    বীরবাহা, জ্যোৎস্না, সন্ধ্যারানি – নতুন মন্ত্রীসভায় জঙ্গলমহলের তিন আদিবাসী কন্যা 

    Story image

    স্লোগান উঠেছিল, বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়। বাংলা তাই-ই চাইল। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। গতকাল নবান্ন থেকে ঘোষণা করলেন তাঁর আগামী পাঁচবছরের যোগ্য সৈনিকদের নাম। কারা কোন মন্ত্রী হলেন, তা ইতিমধ্যেই সকলে জেনে গিয়েছে। এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বড়ো চমক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রীসভায় জায়গা পেলেন জঙ্গলমহলের তিন মহিলা — পুরুলিয়া মানবাজারের তিনবারের বিধায়ক সন্ধ্যারানি টুডু, বাঁকুড়া রানিবাঁধের বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি এবং ঝাড়গ্রামের নতুন বিধায়ক বীরবাহা হাঁসদা।

    দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রার্থী তালিকাতেও ছিল মহিলা মুখের ভিড়। যাঁদের অধিকাংশই জিতে নিজেদের জায়গা পাকাপাকি করে ফেলেছেন। জঙ্গলমহল এলাকা থেকে কোনো পুরুষ নয়, তিন দাপুটে কন্যাদেরই এবার দিলেন মন্ত্রীত্ব। পুরুলিয়া কাদলাগোড়া গ্রামের বাসিন্দা সন্ধ্যারানি টুডু (Sandhyarani Tudu) এবার জয়ের হ্যাটট্রিক করলেন। এই মানবাজার আসনে তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যারানি টুডু ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির গৌরী সিং সর্দার পেয়েছেন ৪১ শতাংশ ভোট। কেন্দ্রটি বরাবর তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। সেখানে সন্ধ্যারানি পরপর তিনবার জিতে বিধায়ক হয়েছেন। এবছর তাঁর হাতেই গেল পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীত্ব। যদিও এর আগে ২০১৬ সালে তিনি অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তার আগে ২০১১ সালে বিধায়ক হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ২০১২ সালে তাঁকে পরিষদীয় সচিব করা হয়। অর্থাৎ ধাপে ধাপে জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার ঘরের মেয়ের রাজনৈতিক উত্তরণে খুশি পুরুলিয়াবাসী। মন্ত্রী তালিকা ঘোষণার পর সন্ধ্যারানি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে পালন করব। এবার জঙ্গলমহল আমাদের নেত্রীকে উজাড় করে ভোট দিয়েছে। বিশেষ করে মহিলারা। তাই নেত্রী সেই পুরস্কার হিসাবে এই জঙ্গলমহলের আমাদের তিন মহিলাকে নবান্নে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা গর্বিত।”বাঁকুড়ার হিড়বাঁধের বাসিন্দা জ্যোৎস্না মান্ডি (Jyotsana Mandi)। ২০১৬ সালে প্রথম রাজনীতিতে পা দিয়ে বিধায়ক হন। তবে তাঁর পরিবারে ছিল রাজনীতির আবহ। দাদু মকর টুডু ছিলেন সিপিএমের দাপুটে বিধায়ক। জ্যোৎস্না এবার খাদ্য ও খাদ্য সরবরাহ প্রতিমন্ত্রী।

    মন্ত্রীসভা ঘোষণার পর জ্যোৎস্না ট্যুইট করে লেখেন, “আমরা দূর্বার আমরা প্রগতি/ আমরা ধান্য ধরিত্রী/ আমরা বাংলার মেয়ে/ আমরাই দেশের কন্যাশ্রী। 

    বাংলার ঘরের মেয়ে আমাদের ভালোবাসার দিদি ২০২১-এর এই জয়কে নারীশক্তির জয় বলেছেন, আমরা বাংলার সেই নারীশক্তি যারা দিদির দেওয়া ১০ অঙ্গীকারকে স্বার্থক করে তুলবো।”

    তিনি আরও বলেছেন, “মেয়েরা শুধু হেঁশেল সামলায় তা নয়। সব কাজই করতে পারে।”তৃণমূল কংগ্রেসের নবতম সংযোজন সাঁওতাল চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী তরুণী বীরবাহা হাঁসদা (Birbaha Hansda)। তৃণমূলে যোগ দিয়েই ঝাড়গ্রাম থেকে টিকিট পেয়েছিলেন। জিতলেনও। যদিও তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে আগেই। তাঁর বাবা নরেন হাঁসদা প্রতিষ্ঠিত ঝাড়খণ্ড পার্টির (নরেন) সক্রিয় সদস্য ছিলেন। মা চুনিবালা হাঁসদাও ছিলেন বিধায়ক। বরাবর সমাজসেবার কাজে যুক্ত শান্ত স্বভাবের এই মেয়ে। রাজনীতির ময়দানে বীরবাহার উত্থান ধূমকেতুর মতো। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছেন বন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। নির্বাচনের আগে বঙ্গদর্শনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বীরবাহা বলেছিলেন, “বিজেপি সবসময় চেষ্টা করেছে আদিবাসীদের জল-জমিন-জঙ্গলের অধিকার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। আমি সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করব। তাছাড়া আদিবাসীদের নিজস্ব যে দাবিদাওয়া, সেগুলো নিয়ে সোচ্চার হব আমি।”

    এই দাবিদাওয়া নিয়েই তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঝাড়গ্রামের মানুষ তাঁকে বিপুল সমর্থন জানিয়েছে। মন্ত্রী হবার পর এই নতুন বন প্রতিমন্ত্রী বঙ্গদর্শনকে জানান, “আমি মানুষের যে সমর্থন পেয়েছি তাতে আপ্লুত। আমিও সব উজাড় করে দিতে চাই। মহিলারা চারদিকে সেভাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন, সেই জায়গায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের এতখানি সম্মান দিচ্ছেন। জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি লড়াই করে চলেছেন। তাঁর মন্ত্রীসভার তালিকা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে উনি আমাদের মতো তিনজন আদিবাসী মহিলাকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছেন। এটা একমাত্র আমাদের নেত্রীই ভাবতে পারেন।”শুধুমাত্র আদিবাসী নন, সমস্ত পিছিয়ে পড়া মানুষদের হয়ে মন্ত্রীসভায় কথা বলবেন এই তিন রাজনীতিক। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র জানাচ্ছেন, “প্রথমত এত সংখ্যক মহিলা মুখ দেশের আর কোনো রাজ্যে নেই, এমনকি কেন্দ্রেও নেই। এছাড়া পিছিয়ে পড়া মহিলাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার প্রয়াসে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। এরপর তাঁরা কেমন কাজ করছেন সেটা পরের কথা। আমি এটার মধ্যে লিঙ্গসমতা দেখতে পাচ্ছি। সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধি রাখার যে চেষ্টা, তাকে আমাদের সাধুবাদ জানাতেই হবে। আদিবাসী সমাজ যদি দ্যাখে, তাদের কথা উপরমহলে আলোচনা হচ্ছে, তার একটা ভালো প্রভাব বৃহত্তর সমাজেও পড়ে।”

    বীরবাহা হাঁসদার বাবা নরেন হাঁসদার প্রসঙ্গ টেনে শুভাশিসবাবু বলেন, “নরেন হাঁসদা আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। উনি পাঁচবছর বিধায়ক ছিলেন ঝাড়খণ্ড পার্টি থেকে। তখন বাম আমল। নরেন বিধানসভায় সাঁওতাল ভাষায় বক্তব্য রাখতেন। এবং বলতেন সেটা বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে। যার ফলে অনেকেই বুঝতে পারতেন না, তিনি কী বলছেন। এমনকি সাংবাদিকরাও বেশ অসুবিধায় পড়তেন। এইভাবে নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিবাদ জানাতেন নরেন। জানি না, তাঁর মেয়ে বীরবাহা এগুলো জানেন কী না। জানলে নিশ্চয় গর্বিত হবেন। পাশাপাশি এই প্রশ্নটাও তুলব, সাংবাদিকদের মধ্যে কি কোনো আদিবাসী প্রতিনিধি আছেন? এই দিকটাও ভাবা উচিত।”

    কথা রেখেছে জঙ্গলমহল (Jangalmahal)। ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে পদ্মের দাপটে প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল ঘাসফুল। সেই মাটিতেই এবার জোড়াফুলের জয়জয়কার। হারানো জমি ফিরে পেয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এবার জঙ্গলমহলের মাটি থেকেই উত্তরণ হল তিন মহিলা মন্ত্রীর। আসলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই জয় মানুষেরই জয়। কবীর সুমন (Kabir Suman) সেই কবেই লিখে গিয়েছিলেন, “আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে...”। জল-জমি-জঙ্গলের প্রতিবাদ চলবে দেশজুড়ে। আর দেশবাসী আশা করবে সন্ধ্যারানি, জ্যোৎস্না, বীরবাহাদের মতো অসংখ্য আদিবাসী মহিলা বিধানসভা, লোকসভায় রাজত্ব করবেন আর টগবগ করে ছুটবেন। 

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @