নতুন ধান্যে হবে নবান্ন


অঘ্রানের মাঠে মাঠে সোনালি ধান। উত্তুরে হাওয়ায় লেগেছে শীতের কাঁপন। ইতু সেঁজুতি ব্রত-য় মাতোয়ারা অঘ্রানের সকাল সন্ধ্যা। একসময় অঘ্রান ছিল বছরের প্রথম মাস। 'অগ্র' শব্দের অর্থ আগে। আর 'হায়ণ' মানে বছর। এই হিসাবে বাংলার নববর্ষ ছিল ১লা অঘ্রান। তখন বলা হত মার্গশীর্ষ। অনেকই বলেন 'অগ্রহায়ণ" শব্দের অভিধানিক অর্থ- বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি বা ধান উৎপন্ন হয়। অতীতে কনকচূড়, কাঙুদ, কলমা, কসুমশালী, খিরখম্বা, গোতমপলাল, ঝিঙাশাল, সীতাশালী, লাউশালী, মুক্তাহার, মৌকলস গোবিন্দভোগ ইত্যাদি কুলীন ধানগুলি কাটা হতো অঘ্রান মাসে। সেইসব ধানের অন্ন দিয়ে জমে উঠতো নবান্ন উৎসব। আজও অতীতের ঐতিহ্য মেনে সারা অঘ্রানমাস জুড়ে রাঢ়বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় সাড়ম্বরে এই কৃষি-উৎসব। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'নতুন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে'।

অস্ট্রিক ভাষাভাষী প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীই নাকি প্রথম ধান চাষ শুরু করেন বঙ্গোপসাগরের অববাহিকা অঞ্চলে। বর্ধমান জেলার ‘পান্ডুরাজার ঢিবি’ উৎখননে তাম্রযুগের প্রাচীনতম অধিবসতি পর্বে মিলেছে ধানের প্রত্ন-নিদর্শন। সেনবংশের তাম্রলিপিগুলিতে দেবদেবী বন্দনার পাশাপাশি ধান্যবন্দনার বাণীচিত্রও খোদিত হয়েছে। ক্রমশ ধান হয়ে ওঠেছে বাঙালি কৃষ্টির অন্যতম মাঙ্গলিক প্রতীক। নবান্ন এক প্রাচীন উৎসব। উল্লেখ রয়েছে বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তরখন্ড, দশম অধ্যায়ে--
মার্গশীর্ষে মহাভাগে নবান্নৈঃপূজয়েদ্ধরিম
পায়সংশর্করা দুগ্ধং দদ্যাৎ কৃষ্ণায় ভক্তিতঃ
অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন দ্বারা হরিপূজা করার বিধি আছে। তাঁকে ভক্তিপূর্বক দুধ ও চিনি এবং পায়েস নিবেদন করতে হবে। পরবর্তীকালে শ্রেণি ধর্ম নির্বিশেষে গ্রাম্যবাঙালির ফসল কাটার প্রাক উৎসবে পরিণত হয় নবান্ন। কৃষিজীবী মুসলমানদেরও বড়ো প্রিয় উৎসব এটি। গ্রাম্যবাঙালির যথার্থ সার্বজনীন লোকউৎসবের দৃষ্টান্ত নবান্ন। অনেকেই বলেন বৈদিক যুগে বিশেষ বিশেষ ঋতুতে যজ্ঞ সম্পন্ন হতো। অগ্রহায়ণ মাসে 'আগ্রায়ণ ইষ্টি' নামে এক ঋতুযজ্ঞ হতো। সেই যজ্ঞে সুনাশীর নামে এক কৃষিদেবতাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হতো। হয়তো সেই থেকেও নবান্ন উৎসবের সূচনা হতে পারে।

গ্রামবাসীরা আগে থেকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে নবান্নের দিন ঠিক করে নেয়। গিন্নিরা সকাল সকাল স্নান সেরে নেন। নতুন বস্ত্র পরে নতুন হাঁড়িতে নতুন অন্ন পাক করেন নব উদ্যমে। লাল-মাটি দিয়ে নিকানো তকতকে উঠোন সুচিত্রিত হয়ে ওঠে মাঙ্গলিক আলপনায়। সকালেই ‘চাল-নবান’ পর্ব। চালের গুঁড়ির সঙ্গে নানাবিধ মিষ্টি আর ফলমূলের মিশ্রণ। এক অলৌকিক স্বাদ! কলার পাতায় গ্রাম-দেবতা, পিতৃ-পুরুষের নামে নৈবেদ্য। পশু পাখি রবাহুত অনাহুত সকলকে নবান্ন খাইয়ে বাড়ির সকলে বসে একসঙ্গে পঙক্তিভোজনে। সবার শেষে গৃহকত্রী নবান্নের প্রসাদ গ্রহণ করেন। দুপুরে ‘ভাত নবান’। বিভিন্ন ভাজাভুজি যেমন আখ, কলা, নারকেল, তিল, পিটালি ভাজা ইত্যাদি। পালং শাকের ঘন্ট। ডাল-ফুলুরি, বেগুন, আলু,বড়ি, কুমড়ো দিয়ে রাঁধা অমৃতময় শুকতুনি। আঁদলসা, বড়া, আলু-ফুলকপির ডালনা, রুই-পোস্ত, কাৎলার কালিয়া, মেথি ভাজার গুঁড়ো ছিটানো শোলমাছের টক। নানা ধরণের পায়স।চিনি দুধ নারকেল কোড়া মেশানো থকথকে রসা। এতে প্রকাশিত হয়েছে বাঙালির রন্ধনশিল্পের এক পরম্পরা। পরের দিন বাস নবান। রসিয়ে পান্তা খাওয়ার দিন। অনেক গ্রামে তারপরের দিন তেসনবানেও ধূমধাম হয়।
নবান্নকে ঘিরে ঘিরে গ্রামে গ্রামে উৎসবের ঢেউ। হেমন্তের শিশির ভেজা রাতে জমে ওঠে যাত্রাপালার জমাটি আসর। কোথাও লেটো আলকাপের মুক্তমঞ্চ। কোথাও বা কবিগান সত্যপীরের দরদী লোকজ গান। গ্রামে গ্রামে ফুটবল, কাবাডি তাসখেলার আয়োজন। কোথাও বা দল বেঁধে মেলা দেখতে যাওয়ার ব্যস্ততা। প্রতি গ্রামে পূজিতা হচ্ছেন দেবী অন্নপূর্ণার মৃন্ময়ী প্রতিমা। তিনি ক্ষুধার্ত শিবকে অন্ন দান করছেন স্মিতহাস্যে। হাতে তাঁর অন্নের পাত্র। এই তো বাঙালির চিরন্তন কামনা। যেন নবান্ন উৎসবের রঙিন প্রচ্ছদপট! অনেক গ্রামে আবার নবান্নে কার্তিকঠাকুর পুজোর ধূম লেগে যায়।

নবান্ন আসলে বেঁচে থাকার কথা বলে। দুর্ভিক্ষ, আকাল, যুদ্ধ, মন্বন্তর, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করার কথা বলে। বিজন ভট্টাচর্যের নবান্ন নাটকে আকাল পীড়িত ক্ষুধার্ত গ্রাম্যচাষীরা নগরের পথে পথে ফ্যান চায়। অনেক লড়াই আর স্বজন হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসে নতুন জীবনের অঙ্গীকার করে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রান্তিক মানুষ ঈশ্বরী পাটনি। দেবীর দয়া লাভ করেও ঘড়া ঘড়া মোহর চায়নি। চেয়েছিল একমুঠো অন্ন, প্রিয় সন্তানের জন্য - আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসের হত-দরিদ্র গনোরি তেওয়ারির দল। দীর্ঘ নয় মাইল পথ হেঁটে এসেছিল স্রেফ এক মুঠো গরম ভাত খাওয়ার আশায়। আমাদের মহাকরণ বাড়ির নামও নবান্ন।
আজও আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নীচে অসংখ্য বুভুক্ষু মানুষ। কালাহান্ডি, আমলাশোলের রূঢ় বাস্তবতা এখনও বাসি হয়নি। পেটে জ্বলছে ক্ষিদের লেলিহান আগুন। কবির অন্তরঙ্গ উচ্চারণে -
স্বপ্ন ছিল দুনিয়ার সমস্ত মা-ই একদিন
সব কুচো কুচো বাচ্ছাদের ধোঁয়া উঠা ভাত বেড়ে দেবে।
নবান্ন এই ক্ষিদে জয় করার উৎসব। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের বাস্তবতা। ব্যাকুল মাতৃমূর্তির অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠার লৌকিক কাহিনি - এই নবান্ন উৎসব।