হাতেকলমে ধর্মনিরপেক্ষতার সফল প্রয়োগ করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র

প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল আমাদের ভারতবর্ষ। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন, কারাবন্দি হয়েছেন, আরও অনেকরকম নির্যাতন-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। তবুও নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, অবলীলায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নেতৃস্থানীয় লড়াকু বীর। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন, কিন্তু সরকারের উচু পদের মোহ তাঁকে কখনই আকর্ষণ করেনি। দেশের মুক্তিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন, তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছেন ব্রিটিশ শক্তিকে। এই নির্ভীক স্বাধীনতা সংগ্রামী ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের ব্যাপারেও ছিলেন দুর্দমনীয়। নিজে হাতেকলমে তিনি এই মহান আদর্শের সফল প্রয়োগ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতেন সুভাষচন্দ্র। ছোটোবেলায় তিনি স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, পেয়েছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের শিক্ষা। যখন তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, তখন হিন্দু, মুসলমান, শিখের মতো নানা ধর্মের অনুগামী মানুষরা ছিলেন তাঁর আন্দোলনের সঙ্গী। ব্রিটিশ শাসকরা তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখলে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি আফগানিস্তান চলে যান। সেখান থেকে জার্মানি। জার্মানিতে সুভাষচন্দ্রের এক বিশ্বস্ত সহকারী ছিলেন আবিদ হাসান। জার্মানি থেকে ডুবোজাহাজে চড়ে যখন সুভাষচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি জমালেন, তখনও আবিদ তাঁর সঙ্গী ছিলেন। পরবর্তীকালে আবিদ হাসান আজাদ হিন্দ ফৌজে নানান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রেঙ্গুনের একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন আব্দুল হাবিব ইউসুফ মার্ফানি। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের তফবিলে ১ কোটি টাকা দান করেন, নেতাজি তাঁকে ‘সেবক-এ-হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান – বহু ধর্মের মানুষই যোগ দিয়েছিলেন। সবাইকেই আপন করে নিয়েছিলেন নেতাজি। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, বাসনপত্র ব্যবহার করা যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে। আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রীসভায় যেমন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এহসান কাদির প্রমুখ মুসলমানরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল গুলজারা সিং-এর মতো শিখও। একইভাবে, উপদেষ্টামণ্ডলীতেও স্থান পেয়েছিলেন একাধিক ধর্মীয় পরিচয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। নেতাজির ড্রাইভার ছিলেন কর্নেল নিজামুদ্দিন, যিনি তিনটি গুলি খেয়ে সুভাষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ মণিপুরের মৈরাং দখল করে নিলে ভারতের সেই স্বাধীন মাটিতে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শওকত মালিক। নেতাজি যখন শেষবারের মতো আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যান্য প্রিয় সহযোদ্ধাদের থেকে বিদায় নিয়ে বিমানযাত্রা করেন, তখন তাঁর একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন বিশ্বস্ত অফিসার হাবিবুর রহমান।
ব্রিটিশ সরকারের কাছে আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করলে তিনজন সেনাপতি শাহানওয়াজ খান, প্রেম কুমার সেহগল এবং গুরুবক্স সিং ধিলনের বিচারসভা বসে দিল্লিতে। তিনজনের একজন ছিলেন মুসলমান, একজন হিন্দু এবং আরেকজন শিখ। এই বিচারকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, সাম্প্রদায়িক মিলনের নজির সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। আরেক অফিসার রশিদ আলিকে ব্রিটিশ সরকার কারাদণ্ড দিলে কলকাতা-সহ বাংলায় ব্যাপক গণ-আন্দোলন দেখা যায়, ১৯৪৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় রশিদ আলি দিবস। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচার গোটা ভারতের মানুষকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও বেশি উদ্বেলিত করেছিল।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমন এক ভারত গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে সব রকম ধর্মীয় পরিচয়কে শ্রদ্ধা করেই সবাই নিজেদের ভারতীয় হিসেবে ভাবতে ও বলতে গর্ব অনুভব করবেন। এখন ভারতের দিকে দিকে এবং সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিষবাষ্প ধিকিধিকি জ্বলছে। এই সময়ে বড়োই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ। চলুন, আজ নেতাজির জন্মদিনে আমরা শপথ নিই, এক সুন্দর ধর্মনিরপেক্ষ পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
তথ্যঋণ-পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়, রেহান ফজল, হিতেন্দ্র প্যাটেল।