No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরে তৈরি হচ্ছে প্রজাপতি বাগান, কলকাতায় প্রথম

    নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরে তৈরি হচ্ছে প্রজাপতি বাগান, কলকাতায় প্রথম

    Story image

    ক্ষিণ কলকাতার নেতাজি নগর একটি পরিচিত অঞ্চল। এই নেতাজি নগর বাস স্টপেজে নেমে রিকশায় বা পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরে। কলকাতায় নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দির সম্ভবত প্রথম স্কুল, যেখানে প্রজাপতি উদ্যান বা বাটারফ্লাই গার্ডেন তৈরি হচ্ছে। কারণ জানলে একটু অবাক হতে হবে।

    এই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা আগের তুলনায় কমছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীরা হাতে মোবাইল পেয়ে শিক্ষামূলক বিষয়ের চাইতে অন্যভাবে বেশি ব্যবহার করছে। তাই ছাত্রীদের শিক্ষায় মনঃসংযোগ বৃদ্ধির জন্য, একাগ্রতা বৃদ্ধির জন্য নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষিকা ও সহ-শিক্ষিকারা স্কুলে প্রজাপতি উদ্যান তৈরির কাজ সহ আরও বিশেষ কিছু উদ্যোগ শুরু করেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের আশা, প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে এতে সবাই না হলেও বেশিরভাগ ছাত্রীই  লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পারবে। এছাড়া স্কুলে শনিবার করে নাটক, মূকাভিনয় সেখানো হয়। ক্লাস হয় স্পোকেন ইংলিশের। দুটো ভাষাতেই যদি জোর দেওয়া যায়, তাহলে বাংলা মাধ্যম স্কুলের হৃতগৌরব আবার ফিরিয়ে আনা যাবে, এমনই মত শিক্ষিকাদের। স্কুল সম্পর্কে এই তথ্য জানা গেল স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায় গোস্বামীর কাছে।  

    নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৫১ সালের ২ জানুয়ারি। স্কুল প্রতিষ্ঠায় নেতাজি নগরের এক সময়ের বাসিন্দা, উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা ও বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার তৎকালীন মন্ত্রী প্রয়াত প্রশান্ত শূরের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। এছাড়া দেশভাগের পর এপার বাংলায় চলে আসার পর, নেতাজি নগর কলোনি প্রতিষ্ঠা যাঁরা করেছিলেন, সেই নাগরিক সমাজ, শিক্ষানুরাগীদেরও বড়ো ভূমিকা ছিল। এক সময় এই স্কুলে নেতাজি নগর কলেজের ক্লাস হতো। স্কুলের শুরুর সময় থেকে ১৯৮৮ সাল বা তারও কিছু সময় পর পর্যন্ত প্রধান শিক্ষিকার পদে ছিলেন শেফালী গুপ্ত। স্থানীয় এলাকায় তিনি বড়দি নামেই পরিচিত ছিলেন, তিনি এবং সেই সময়কার অন্যান্য শিক্ষিকারা একত্রে নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দির স্কুলটিকে চারা গাছ থেকে বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন। তখন ছাত্রী সংখ্যাও আজকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তবে বর্তমানে বাংলা মাধ্যমে পড়ানোর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অনীহা এবং ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের পড়ানোর অতিরিক্ত আগ্রহ আজ কলকাতা ও শহরতলীর বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে শহুরে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলছেন। এছাড়াও লটারি পদ্ধতি, দীর্ঘদিন ধরে স্কুল-চাকরির পরীক্ষা না হওয়া, উপযুক্ত মেধা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাবও এর অন্যতম কারণ। স্কুলে করোনা পরবর্তী প্রভাব পড়েছে রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে। এর প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি দক্ষিণ কলকাতার নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরও। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কলোনি এলাকার বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির বেশিরভাগেরই আজ করুণ হাল। তবে এসবের মধ্যেই এই স্কুল লড়াই করে এখনও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে।  

    বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা ২০২১ সালে এই স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে এসে স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। বর্তমানে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ৪২৫জন। ২৭জন শিক্ষিকা, ৩জন অশিক্ষক কর্মচারী আছেন। চারতলা ভবনে ২০টি শ্রেণিকক্ষ  রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে কলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এই তিনটি শাখায় পড়াবার ব্যবস্থা আছে। স্কুলের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল ভালো হয়। তবে এর মধ্যে বাণিজ্য শাখায় উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার ফল অন্য শাখার তুলনায় ভালো। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে সংখ্যার বিচারে সবাই কৃতকার্য হলেও নম্বর প্রাপ্তির দিক থেকে পরীক্ষার ফল আশানুরূপ নয় বলে জানালেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণালীদেবী বঙ্গদর্শন.কম-কে জানান, “ছাত্রীরা সবাই সমান। আমরা অন্তত সেটাই মনে করি। তবে তারা যে পরিবার থেকে আসছে, বেশিরভাগই প্রান্তিক, প্রথম শ্রেণির পড়ুয়া। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার ঝোঁক বৃদ্ধির জন্য মেধাবী ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড় নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরের সংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলি মেয়েদের স্কুল আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্কুলে ইংরেজি মাধ্যম চালু করার, তাতে হয়তো সমস্যা কিছুটা সমাধান হবে। কেননা, আজকাল সবারই একটি করে সন্তান। তাই অভিভাবকরা চাইছেন সন্তানকে তাঁদের সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো শিক্ষা দিতে। তাই বলে বাংলা মাধ্যমকে ভুলে গিয়ে এই কাজটা করতে হবে, এটা ঠিক ভাবনা নয়।”

    নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরে সেমি-স্মার্ট ক্লাস আছে, প্রজেক্টরের মাধ্যমে সেটা করা হচ্ছে। তাতে যে মডিউল আছে সেগুলো চালিয়ে দেখানো হয় ছাত্রীদের। টিবি সচেতনতা, ক্যান্সার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বোড়াল টিবি হাসপাতাল, ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা এসে সচেতনতার পাঠ দিয়ে যান। মহাকাশ সম্পর্কে জানার জন্য প্রজেক্টরের মাধ্যমে ডঃ দেবীপ্রসাদ দুয়ারি স্কুলে এসে ছাত্রীদের কাছে মহাকাশ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হওয়ার জন্য কর্মশালা করিয়ে গিয়েছেন। জীববিজ্ঞানী ডঃ অমলেশ মিশ্র, যিনি জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানী, তিনি একটা প্রজাপতি উদ্যান তৈরির কাজ স্কুলে শুরু করেছেন। স্কুলের নিজস্ব মাঠে এই প্রজাপতি উদ্যান করার কাজ চলছে। প্রধান শিক্ষিকা জানালেন, “স্কুলের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন একটা জায়গা ছিল এটা। আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের সময় একটা গাছের গুড়ি পড়ে  ছিল। কলকাতা পুরসভাকে বলে সেটা সরিয়ে সেই জায়গাতেই মাটি ফেলে গাছ লাগিয়েছি। সেখানেই ডঃ অমলেশ মিশ্রর সহায়তায় তৈরি হচ্ছে প্রজাপতি উদ্যান। কাজটা চলছে। তবে স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি এই কাজ করা কঠিন। সময়টা কম পাওয়া যায়। তারই মধ্যে কাজটা চলছে। আমরা চাইছি, বাচ্চাদের এই মুক্ত প্রজাপতি উদ্যানের মাধ্যমে প্রকৃতি সম্পর্কে, প্রাণী সম্পর্কে সজাগ করতে। আমি আগে মথুরাপুর নারীশিক্ষা স্কুলে ছিলাম। সেখানে অনেক কাজ করেছি। এখানেও চাইছি, স্কুলটাকে আরও ভালো করে পরিচালনা করতে।”

    প্রধান শিক্ষিকা আরও বলছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁরা চাইছেন ছাত্রীদের কিছুটা সুস্থ বিনোদনমূলক কাজের মধ্যে রাখতে। তাই স্কুলে প্রতি শনিবার স্পোকেন ইংলিশ, ক্যারাটে, নাটক সেখান হয়। মূকাভিনয় শেখানোর ব্যবস্থাও হয়েছে। ১৫দিন অন্তর শনিবার করে শেষের দুটো ক্লাস নিয়ে এই ‘আনন্দ পরিসর’ ক্লাসটা হয়। এই ক্লাসেই নাটক সহ অন্যান্য বিনোদনমূলক শিক্ষা দেওয়া হয়। আঁকার কর্মশালা করার ইচ্ছা আছে সপ্তাহে একদিন, দু’ঘণ্টা করে।

    স্কুলে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, কম্পিউটার ল্যাবরেটরি আছে। লাইব্রেরি আছে, তবে লাইব্রেরিয়ান নেই, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে লাইব্রেরিয়ান পাওয়ার কথা থাকলেও সেই পদটি ফাঁকা পড়ে আছে। সোলার পাওয়ার জেনেরেশনের কাজ শুরুর মুখে। স্কুলে সরস্বতী পুজো বড়ো করে হয়। ছাত্রীরা সরকারি বন-মহোৎসব, কন্যাশ্রী দিবসের অনুষ্ঠান, মক-পার্লামেন্ট ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। এছাড়া স্কুলে প্রতি বছর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয় বিদ্যাসাগরের জন্মদিনের দিন। সেদিন ছোটো করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ছাত্রীদের স্কুল থেকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিজ্ঞানমূলক অনুষ্ঠানে বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টুডেন্টস হেলথ হোম থেকে স্কুলে এসে ছাত্রীদের ও শিক্ষিকাদের থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করিয়েছে বিনামূল্যে, দু’বার। এছাড়াও একটি বেসরকারি সংস্থা এসে ছাত্রীদের থাইরয়েড পরীক্ষা করে গেছেন। সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার উদ্যোগেও স্কুলে ছাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় চার-পাঁচদিন ধরে। স্কুলটাকে ভালো ভাবে চালাবার জন্য উদ্যোগের খামতি রাখছেন না শিক্ষিকারা। 

    “রোটারি ক্লাব আমাদের কম্পিউটার দেওয়ার কথা জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই ওয়াটার ফিল্টার দিয়েছে। বাইজু আগামী তিন বছরের জন্য স্টাডি মেটিরিয়াল দেবে অনলাইনে, প্রতি ক্লাসে ৫ জন ছাত্রীকে। এটা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দেওয়া হবে। আমরা চাইছি স্কুলটাকে আরও ভালো করে চালাতে। সব বিষয় পড়াবার জন্যই উপযুক্ত শিক্ষিকা আছেন। তবে স্কুলটা বাস রাস্তা থেকে একটু ভেতরে হওয়ায় সেভাবে নজরে পরে না। আমরা চাইছি নেতাজি নগর বাস স্টপ থেকে স্কুল পর্যন্ত এবং গান্ধি  কলোনি থেকে স্কুল পর্যন্ত যদি স্কুলের নাম লেখা দিকনির্দেশক বোর্ড লাগানো যায়। এটা নিয়ে কলকাতা পুরসভার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে বিষয়টা বাস্তবায়িত করতে পারলে স্কুলটাকে নজরে আনা যাবে।” বলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। 

    প্রধান শিক্ষিকার এই আন্তরিকতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে তিনি এবং তাঁর স্কুলের অন্যান্য সহশিক্ষিকারা আন্তরিকভাবে চাইছেন যাতে নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দির স্কুলটি আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ছাত্রী সংখ্যা আরও বাড়াতে। সেই সঙ্গে  বাঙালি অভিভাবকদের সচেতন হয়ে ভাবতে হবে যে, সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়াবেন। নাহলে বাংলা মাধ্যম স্কুলের খারাপ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। শিক্ষায় মাধ্যমটা একটা বিষয়, তবে বাংলা মাধ্যমে থেকে ইংরেজি শেখা যায় না, এই ধারণার বদল প্রয়োজন। এই ভাবনার পরিবর্তন আনতে অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহমত হওয়া জরুরি। গ্রামে এটা হয় কিন্তু শহরে, শহরতলিতে এই জায়গাটায় পৌঁছানো দিনদিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেন কলকাতার শিক্ষকমহল। এই বিষয়ের সঙ্গে সহমত নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষিকা নিজেও। 

    তথ্য সূত্র: বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায় গোস্বামী, প্রধান শিক্ষিকা, নেতাজি নগর বালিকা বিদ্যামন্দির ,
    স্থানীয় বাসিন্দা, প্রাক্তন ছাত্রী, অভিভাবক
    ছবি: সংগৃহীত

    *কলকাতা, শহরতলি বা জেলার কোনও না কোনও স্কুলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গর্বের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বুনিয়াদি গল্প। এবার সেদিকেই ফিরে তাকিয়ে চলছে নতুন ধারাবাহিক ‘আমাদের ইস্কুল’। সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন চোখ রাখুন প্রতি বুধবার সন্ধে ৬টায়, শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @