‘ভারতের নাগরিকত্ব চেয়েছিলাম, নেহরু কিছু বলেননি’, বললেন নেতাজি-কন্যা অনিতা

চলতি বছরের ১৩ মার্চ ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অস্ট্রীয় স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেল-এর ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। এবং এ বছরই পালিত হচ্ছে নেতাজির ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী। সরকারিভাবে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু ঘোষণার সময় দু’জনের একমাত্র সন্তান ডাঃ অনিতা বসু পাফ-এর বয়স ছিল তিন। তাঁর স্মৃতিচারণের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে ‘দ্য অনিতা ডায়ালগস’ শীর্ষক ১২টি আলোচনা সমৃদ্ধ একটি সিরিজ, প্রযত্নে জার্মানিতে বসবাসকারী বঙ্গসন্তানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘সম্প্রীতি’। ইউটিউবে সম্প্রচারিত এই সিরিজের মূল উদ্দেশ্য, নেতাজির ১২৫তম জন্মজয়ন্তীর যথাযথ উদযাপন। সিরিজ সঞ্চালনার দায়িত্বে রয়েছেন সম্প্রীতি-র প্রতিষ্ঠাতা তথা বর্তমান অধ্যক্ষ, শৈবাল গিরি।
ফেব্রুয়ারি মাসে সিরিজের প্রথম পর্বে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ১৯৪৩ সালে জার্মানি থেকে ডুবোজাহাজে করে সুদূর সিঙ্গাপুর অভিমুখে নেতাজি এবং তাঁর সহকারী আবিদ হাসানের রোমাঞ্চকর সফর। দ্বিতীয় পর্ব সম্প্রচারিত হয় ১৪ মার্চ, যাতে আমরা পাই ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনকে কেন্দ্র করে নেতাজি-গান্ধি-নেহরুর সমীকরণের ইতিহাস। এই পর্বে অনিতার সঙ্গে অতিথি হিসেবে হাজির ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুই ইতিহাসবিদ - প্রফেসর লিওনার্ড গর্ডন এবং ডাঃ রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়। উল্লেখ্য, ত্রিপুরি অধিবেশনেই গান্ধির আপত্তি সত্ত্বেও কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ।গর্ডনের কথায়, মহাত্মা গান্ধির প্রতি বাংলা তথা বাঙালির “পরস্পরবিরোধী” মনোভাবের পিছনে অনেকাংশেই রয়েছে ত্রিপুরি অধিবেশন, যেখানে হার নিশ্চিত ধরে নিয়েই নিজের মনোনয়ন জমা দেন সুভাষ। অথচ ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের হরিপুর অধিবেশনে গান্ধিই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুভাষকে প্রার্থী করতে রাজী হয়েছিলেন, যেহেতু জওহরলাল নেহরু ততদিনে দু’বার সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন। হরিপুরে গান্ধি স্পষ্টতই জানান, সুভাষকে “নির্ভরযোগ্য” মনে করেন না তিনি।
নিজের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গর্ডন জানাচ্ছেন, গান্ধির মতন বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ নেতা সুভাষকে যতটা চিনেছিলেন, হয়তো সুভাষ নিজেও নিজেকে অতটা চিনতেন না। তবে মার্চ মাসে ত্রিপুরির নির্বাচনের সময় থেকে শুরু করে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে যত পত্র বিনিময় হয়, তার প্রায় প্রতিটিতেই দেখা যায় গান্ধি সুভাষকে স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, সুভাষের কোনও নির্দিষ্ট আন্দোলনের পরিকল্পনা না থাকলে তাঁর উচিত “রাস্তা খালি করে দেওয়া”, যাতে “প্যাটেল অ্যান্ড কোং” গান্ধির পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে পারেন।
দুজনের মাঝে দোটানায় পড়ে যান নেহরু, যদিও রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, সুভাষকে কোণঠাসা করার প্রয়াসের মূল কাণ্ডারি ছিলেন চক্রবর্তী রাজগোপালচারি এবং বল্লভভাই প্যাটেলের মতো নেতৃত্ব। বিশেষ করে বল্লভভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দাদা বিঠ্ঠলভাইয়ের উইলকে কেন্দ্র করে চরম বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন সুভাষ। উইলে সুভাষের নামে বেশ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন বিঠ্ঠলভাই প্যাটেল, দেশের কাজে ব্যবহার করার জন্য। এই উইল মেনে নিতে অস্বীকার করেন বল্লভভাই, যার ফলে সূত্রপাত ঘটে এক অপ্রীতিকর আইনি লড়াইয়ের।
আদালতে শেষমেশ জয়ী হন বল্লভভাই, তবে রুদ্রাংশু বলছেন, এর পর উইলে উল্লিখিত প্রত্যেক সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে তিনি প্রায় মুচলেকা আদায় করে নেন যে তাঁরা কেউই বিঠ্ঠলভাইয়ের সম্পত্তির কণামাত্র গ্রহণ করবেন না। বল্লভভাইয়ের রাজনৈতিক অসমর্থন তো ছিলই, তার উপর এই ঘটনায় অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলেন সুভাষ।
অন্যদিকে নেহরু যেমন সুভাষকে ভালবাসতেন, তেমনই অনুগত ছিলেন গান্ধির প্রতি, তবে সেইসময় তিনি গান্ধিকে প্রতিনিয়ত উপদেশ দিয়ে গেছেন যাতে সুভাষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা হয়, কারণ “সুভাষকে এই মুহূর্তে কংগ্রেস ছেড়ে বেরোতে দিতে পারি না আমরা”। পাশাপাশি সুভাষের সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত পত্র বিনিময় চলছে তখন, কখনও কখনও বাগবিতণ্ডাও। রুদ্রাংশুর কথা অনুযায়ী, নিজের মনোভাব জানিয়ে ২৭ পাতার একটি টাইপ করা চিঠি নেহরুকে লিখেছিলেন সুভাষ, এবং তারপর দেখা করার আহ্বান জানানোয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন নেহরু: “সুভাষকে না করতে পারি না আমি।”
সিরিজের এই পর্বে আরও এমন অনেক তথ্য সামনে এসেছে, এবং রুদ্রাংশুর কথায়, ত্রিপুরি অধিবেশনে আমরা দেখতে পাই গান্ধির “হীনতম চেহারা”। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ব্যাপারে সুভাষের প্রতি তাঁর অসহযোগিতার ফলে যথার্থই কোণঠাসা হয়ে পড়েন সুভাষ, যেহেতু ওয়ার্কিং কমিটিকে গান্ধির অনুমোদন পেতেই হবে, এমন একটি রেজোলিউশন ততদিনে পাস হয়ে গিয়েছে। ১৯৩৯ সালের কলকাতা অধিবেশনের প্রাক্কালে নেতাজির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার বিরুদ্ধে একজন নেতাই সোচ্চার হয়েছিলেন, তিনি জওহরলাল নেহরু, বলছেন রুদ্রাংশু।সুভাষের প্রতি গান্ধির এই বিরোধিতার মূলে ঠিক কী? গর্ডন মনে করেন, একটি বড় কারণ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব এবং সেই বিপ্লবের কাণ্ডারিদের সঙ্গে সুভাষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সুভাষ যে কোনোদিনই “১০০ শতাংশ গান্ধিবাদী” হতে পারবেন না, একথা স্বয়ং গান্ধিও জানতেন। রুদ্রাংশু বলছেন, বিষয়টা ছিল নিয়ন্ত্রণের, এবং পন্থ প্রস্তাবে সুভাষের পরিকল্পনাকে “ফুটো নৌকো” হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে রুদ্রাংশু এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৪২ সালে বার্লিন থেকে সম্প্রচারিত আজাদ হিন্দ রেডিওর অনুষ্ঠানে প্রথমবার গান্ধিকে “রাষ্ট্রের পিতা” আখ্যা দেন সুভাষই, কোনও তথাকথিত গান্ধিবাদী নন।
সুভাষ এবং নেহরুর সম্পর্ক শেষমেশ চুকে গেলেও তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষের সম্ভাব্য মৃত্যুর খবর পেয়ে যে প্রকাশ্যেই কেঁদে ফেলেছিলেন নেহরু, একথা একাধিক জায়গায় নথিবদ্ধ হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অনিতার ব্যক্তিগত সংযোজন, ১৯৬১ সালে তাঁর প্রথম ভারত সফরের স্মৃতি। সেবার তাঁকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান নেহরু, যদিও অনিতা যখন জানতে চান তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন কিনা, হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। অনিতার মতে, নেহরু না হলেও “নেহরু-গান্ধি পরিবারের ঘনিষ্ঠরা” নেহরু-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির ভূমিকাকে খর্ব করতে চেয়েছেন।
আলোচনায় আরও উঠে এসেছে কীভাবে প্রথমে গান্ধি, এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় ফজলুল হক এবং শরৎ বসুর সম্ভাব্য জোট সরকারের বিরোধিতা করার ফলে জেলে যেতে হয় শরতকে। গর্ডনের লেখা ‘ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ (Brothers Against the Raj)’ বইটির উল্লেখ করে রুদ্রাংশুর বক্তব্য, সুভাষ-শরৎ দুই ভাইয়েরই স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়ার মূলে রয়েছে ব্রিটিশ জেলে তাঁদের কয়েদী জীবন।
সিরিজের আগামি পর্বে দেখা যাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি বাহিনীর একদা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশা সহায়কে। তাঁর বাবা আনন্দমোহন সহায় ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের উচ্চপদস্থ অফিসার। আলোচনার বিষয় হবে ডুবোজাহাজ সফরের পর নেতাজির ভারতে পুনরাগমন।