No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ২০০ বছরে মুর্শিদাবাদের প্রাচীনতম বিদ্যালয় নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন

    ২০০ বছরে মুর্শিদাবাদের প্রাচীনতম বিদ্যালয় নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন

    Story image

    মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনের প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। এখানকার নিজামত হস্টেল, দরবার হল, গম্বুজ, স্কুল ভবন সবেতেই নিজাম আমলের স্মৃতি এখনও জীবন্ত করে রেখেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

    আজ যাকে আমরা মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন বলি সেটা প্রথমে ছিল নবাব আমলের একটি কলেজ ও মাদ্রাসা। পাশ্চাত্য শিক্ষায় নিজামের পরিবারের ছেলেদের শিক্ষিত করে তুলেতে নবাব নাজিম সৈয়দ মহম্মদ আলী খাঁ ওরফে ওয়ালা জাঁ নবাব নগরী মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির পাশেই একটি কলেজ স্থাপন করতে চাইলেন । ১৮২৪ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি নবাব হুমায়ূন জাঁর সুপারিশে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ১৮২৫ সালের ২৭ মে ওই কলেজ খোলার অনুমতি দিলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পুরোটাই একটা ইতিহাস। 

    শুরুতে ইসলামিক স্থাপত্যের স্মারক ‘মোবারক মহল’-এ কলেজের পঠনপাঠন শুরু হয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই কর্নেল ম্যাকলয়েড ওই কলেজ ভবনের নতুন নকশা তৈরি করেন। এই ম্যাকলয়েড সাহেবই হাজারদুয়ারি প্রাসাদের নকশা করেছিলেন। ওই সময় গ্রীক বা ডোরিক এবং ইতালিয়ান স্থাপত্যের আদলে কলেজ গড়ে তুলতে নিজামত ডিপোজিট ফান্ড বা নবাবের তহবিল থেকে ৭৬,৫০০ টাকা খরচ হয়েছিল। সঠিক অর্থে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে লন্ডন মিশনারি সোসাইটি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল রেভারেন্ড মিঃ প্যারটনকে।

    এর পর ১৯০৯ সালে নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলী মির্জা ইংরেজি, আরবি, পারসি, বাংলা, উর্দু ও গণিতের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের পড়াশুনার সুবিধার জন্য কলেজ ও স্থানীয় বিদ্যালয়কে সংযুক্তিকরণ করেন, তখন থেকে ওই বিদ্যালয়ের নামকরণ হয় নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন। এই স্কুলটিই এখনও পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীনতম বিদ্যালয়। ঐতিহাসিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিদ্যালয়টিকে হেরিটেজ ঘোষাণার দাবি রয়েছে স্থানীয় মানুষ এবং বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের মধ্যে । এই স্কুলের শিক্ষকদের বক্তব্য,  “নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এটা নিছক একটা স্কুল নয়, এর একটা নবাবী ইতিহাস আছে। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যমেই দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন নবাব। ঐতিহাসিক  দিক থেকে এই বিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং বিদ্যালয়টিকে অবিলম্বে হেরিটেজ ঘোষণা করা হোক।”

    কথা হচ্ছিল মাসুদ আলমের সঙ্গে। ২০১৭ সালে নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন-এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে আসেন এই মাসুদ আলম। থাকেন বহরমপুরে। তাঁর স্কুলে এখন ৯৪০ জন ছাত্র, বাংলা, উর্দু এবং ইংরেজি মিলিয়ে মোট তিনটে মাধ্যম। ৯৪০ জনের মধ্যে উর্দু মাধ্যমে ২৭ জন ছাত্র, ইংরেজি মাধ্যমে ২৪০ জন ছাত্র বাকি পড়ুয়ারা বাংলায় মাধ্যমে পড়ছে।

    মাসুদ আলম বলছিলেন, “১৮২৫-এর ২৭ মে আজকের নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন ছিল নিজামত কলেজ বা মাদ্রাসা। নবাব এবং নবাব পরিবারের ছেলেদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু। তখন নবাবদের ‘নিজাম’ বলা হতো। নিজাম পরিবারের ছেলেদের শিক্ষার জন্য মূলত এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা। মীরজাফরের ছেলে নবাব মুবারকদৌল্লার দরবার বা মুবারক মহল ছিল যেটা, সেটাই এখন শিক্ষকদের বসার ঘর বা স্টাফ রুম। এই দরবার হলের ওপরে যে গম্বুজ রয়েছে তার পাশে নিজামের যে থাকার জায়গা সেটাকে নবাব পরিবারের ছেলেদের থাকার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এটাই আজকের নিজামত হোস্টেল। তখন নিজামত হোস্টেলে নবাব পরিবারের যে পড়ুয়ারা থাকতেন তাঁদের পড়া, থাকা, খাওয়া, ওষুধ, চুল কাটার খরচ সব দেওয়া হত। আজও সেই ব্যবস্থা নিজামত হোস্টেলে চালু আছে, শুধু ওষুধটা দেওয়া হয় না।”  

    আগেও যেমন নিজামত হোস্টেলে শুধুমাত্র নবাব পরিবারের ছেলেরাই থাকত, এখনও থাকে। আগে নিজামত হোস্টেলে নবাব পরিবারের ছেলেরা ২৪ ঘণ্টাই থাকতো। পড়াশোনা, প্রার্থনা ইত্যাদি করত। এখন শুধু দিনের বেলাতেই নবাব পরিবারের ২৭ জন পড়ুয়া এই নিজামত হোস্টেলে থাকে।

    নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনে শেষ আতালিক ছিলেন সৈয়দ আপক আলি মীর্জা। তিনি উর্দু কবিতা লিখতেন, বাচ্চাদের জাতীয় সংহতি, সর্বধর্ম সমন্বয় নিয়ে শিক্ষা দিতেন।

    এখন নিজামত হোস্টেলে পড়ুয়ারা রাতে থাকে না, তার কারণ বলতে গিয়ে মাসুদ আলম বললেন, “নিজামত হোস্টেলে ‘আতালিক’ নামের একটা পদ ছিল। এই আতালিক পদে যিনি নিযুক্ত হন তাঁকে সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হয়। নিজামের পরিবারও ছিল সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এই আতালিকের কাজ ছিল, নিজামের বাড়ির ছেলেদের ধর্মীয় শিক্ষা, পড়াশোনা, জীবন গড়ার শিক্ষা এবং দেশাত্মবোধ শেখাতেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০০০ সাল পর্যন্ত অতালিকের পদ ছিল এবং এই পদে শেষ যিনি ছিলেন, তিনি ২০০০ সালেই অবসর নেন। আতালিক যতদিন নিজামত হোস্টেলে ছিলেন, ততোদিন রাতেও নিজামত হোস্টেলে নবাব বাড়ির ছেলেরা থাকত। ২০০০ সালে আতালিক পদের শেষ চাকুরে অবসর নিয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে নিজামত হোস্টেলে নতুন কোনও আতালিক নিযুক্ত হননি। আর তাই আতালিক না থাকায় হোস্টেলের সব সুবিধা পেলেও ছাত্ররা রাতে আর নিজামত হোস্টেলে থাকে না। ১৯০৯ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংযুক্তিকরণ হয়ে নিজামত মাদ্রাসা, নিজামত স্কুল এক হয়ে ‘নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন’ হয়। এর আগেই, ১৮৮৬ সালে নিজামত কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন হওয়ার পরও সংবিধান অনুসারে আতালিকের পদ ছিল। এই পদে আতালিককে সিয়া সম্প্রদায়ের হতে হবে, এটাই বিধি। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে কোনও পদে নিয়োগ এখন হয় না। তাই আতালিকের পদে নিয়োগ এখন বন্ধ।” 

    মাসুদ আলম আরও বলছিলেন, “নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনে শেষ আতালিক ছিলেন সৈয়দ আপক আলি মীর্জা। তিনি উর্দু কবিতা লিখতেন, বাচ্চাদের জাতীয় সংহতি, সর্বধর্ম সমন্বয় নিয়ে শিক্ষা দিতেন। এই বিষয়গুলি তিনি ধর্মের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে শেখাতেন। জীবনযাপনের কেনটা সঠিক পথ, সেটাও তিনি ছেলেদের বলে দিতেন, পড়াতেন। অসাধারণ ভারসাম্য বজায় রেখে তিনি বাচ্চাদের পাঠদান করতেন। খুবই সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। ২০২১ সালে তিনি প্রয়াত হন।” 

    ইতিহাস বিজড়িত নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন-এর পড়াশোনা ও পরীক্ষার ফল কেমন হয় সেই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল বর্তমান প্রধান শিক্ষক মাসুদ আলমের সঙ্গে। যিনি বললেন, “গত ২০২২-এ মাধ্যমিকে ৬৮৮, উচ্চমাধ্যমিকে ৪৭৯ নম্বর পেয়েছে এই  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই ছাত্র। এই বছর জেবিএনএসটিএস-এ রূপায়ন মণ্ডল সপ্তম এবং তুহীন শুভ্র ৩৫ তম স্থানলাভ করেছে। আমাদের স্কুলের ছাত্ররা গত ৩ বছর ধরে রাজ্যে স্পোর্টস চ্যাম্পিয়ন। সাই-এর মাঠে ফেব্রুয়ারির ১০, ১১ ও ১২ তারিখ স্পোর্টস-এ অংশ নিয়ে রাজ্যের মধ্যে সেরার শিরোপা ছিনিয়ে এনেছে। ২০২৪ সালে আমাদের স্কুল ২০০ বছরে পড়ছে। এই বছরটা আমরা বড়ো করে স্কুলের ২০০ বছর উদযাপন করব। ২০০ বছর নিয়ে ইতিমধ্যেই গান তৈরি হয়েছে। গান লিখেছে স্কুলেরই এক ছাত্র, গেয়েছে সুরজ নাগ, সারেগামাপা-য় অংশগ্রহণকারী একজন। এবারের স্কুলের স্পোর্টসের সময় এই গানটির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। অনুষ্ঠানে মুর্শিদাবাদের ডিএম, এসপি ছিলেন।”

    নবাবের জায়গা মুর্শিদাবাদ। এখানকার হাজারদুয়ারির পাশেই রয়েছে নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন। এই স্কুল, স্কুলের উপরের গম্বুজ, নিজামত হোস্টেল দেখতে বহু মানুষ আসেন। মাসুদ আলম বলছিলেন, “মুর্শিদাবাদের মধ্যে এই গম্বুজটি সবচেয়ে উঁচু।” পুরোনো রীতি মেনে শনিবার নিজামত হোস্টেলের ছেলেদের এখনও খাওয়ানো হয়। বাকি ছাত্রদের জন্য মিডডে মিল আছে। এখন সারা রাজ্যে ২০ টাকা করে মিডডে মিলের বরাদ্দ বাড়লেও মুর্শিদাবাদে ডিএম আরও ১০ টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা মাথাপিছু মিডডে মিল বরাদ্দ করেছেন। প্রধান শিক্ষক মাসুদ আলম সব কথার শেষে বলছিলেন, “নবাবী রীতি মেনে এখনও নিজামত হোস্টেলের বোর্ডারদের প্রতি শনিবার দুপুরে মাটন বিরিয়ানি ও শাহী টুকরা দেওয়া হয়। আসবেন কোনও এক শনিবার, ভালো লাগবে।”

    ____________________

    তথ্য সূত্র:- মাসুদ আলম, প্রধান শিক্ষক, নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন

    ছবি:- সংগৃহীত

    *কলকাতা, শহরতলি বা জেলার কোনও না কোনও স্কুলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গর্বের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বুনিয়াদি গল্প। এবার সেদিকেই ফিরে তাকিয়ে চলছে নতুন ধারাবাহিক ‘আমাদের ইস্কুল’। সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। চোখ রাখুন প্রতি বুধবার সন্ধে ৬টায়, শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @