স্মৃতির শহর কলকাতা

স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। সেই ছবি হাতড়িয়েই নতুন বছর শুরুর মুখে আজ দেখতে বসেছি বন্ধ চর্চার নানা ছবি।
রাত ফুরলেই নতুন বছরের শুরু। এক কালে নতুন বছর আসার কিছুদিন আগে থেকেই কলকাতার অনেক বাড়িতে ঢুকে যেত ‘শুর’ কোম্পানির ডাইরি, কিংবা প্রিয়জনদের কাছ থেকে গ্রিটিংস কার্ড। তাছাড়া বাড়ির ছোটরাও খালি কার্ডে ছবি এঁকে গ্রিটিংস কার্ড বানাতো সেই ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিক থেকেই। যুগ বদলের সাথে সাথে ওসবের পাট চুকেছে। তাছাড়া বড় বড় কোম্পানিগুলো যে সব ক্যালেন্ডার বানাতো তাও ছিল শিল্পসম্মত। যেমন একবার এয়ার ইন্ডিয়া বিমান সংস্থা বানালো ‘লালা দিনদয়াল’ এর তোলা ছবি দিয়ে একটা অসাধারণ ক্যালেন্ডার। পরিচিতিতে বলা হয়েছিল যে গ্লাস নেগেটিভ থেকে প্রিন্ট করে সেগুলি ছাপা হয়েছিল। পাশা পাশি কলকাতার অন্যান্য বিমান কোম্পানিগুলি যারা ভিনদেশী তারাও কম যেত না। একবার থাইল্যান্ডের থাই এয়ারলাইনস কোম্পানি ওদেশের রাজা ‘ভূমিবল’ এর আঁকা ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার বের করেছিল।নতুন বছরের শুরুতে বিগত সময়ের এই উজ্জ্বল দিনগুলির কথা মনে পড়তে চায়। আমার 'বন্ধ' চর্চাটা একটু আলাদা। যদিও এটা অস্বীকার করি না যে আদালত আর রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে ‘বাংলা বন্ধ’ এর চর্চাটিও বন্ধ হয়ে গেলো। আর লেজুড় হিসেবে বন্ধ হল আধ খোলা টিনের ঝাপের তলা থেকে হাতে গরম ঠাকুরের আলুর চপ, ‘এক ফালি ফুটো টিনের বন্ধ দরজা’ থেকে হাত বাড়িয়ে নেওয়া গরম চা, রাস্তার ক্রিকেটে সুনীল গাভাসকারি চাল বোল ও সুনসান ফাকা রাস্তায় ‘বন্ধ মানছিনা, মানবোনা’ জাতীয় অলীক স্লোগান।
নতুন বছরের কলকাতার দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে যে, নিদেনপক্ষে আমি যেখানে জন্মেছি সেই টালিগঞ্জ বা কুঁদঘাট আমার চোখের সামনে পালটে গিয়েছে। আমার মামা বাড়ির গা-বেয়ে তখন চলেছে আদিগঙ্গা। যাকে আমরা ইতিহাসের পাতায় টলির নালা বলে থাকি। কিন্তু আজ তার উপর দিয়ে ঝমঝম করে চলে যায় মেট্রো রেল। যদিও সেই নালাতে কাঠের পুলের উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মত অনেকেই দেখেছেন দু-চারটে খড়ের বা কলসির নৌকো। নতুন বছরের প্রথম দিন কুঁদঘাটের নেতাজি মেলার মাঠে বন ভোজন করার ফাকে ফোকরে আমরা এক দল বাচ্চা কাচ্চা লাইন দিয়ে কাঠের পুলের উপর থেকে কাগজের পাখা বানিয়ে হাওয়ার গায়ে ভাসিয়ে দিতাম। এখন আর সেই সুযোগ নেই। আমাদের সেই চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দিন।
সেই সূত্র ধরেই বলি বিলাশপুরের দাদুকে যখন প্রথম হলদে পোস্টকার্ডে নতুন বছরের চিঠি লিখেছিলাম সেই দিনের সেই পোস্ট কার্ডের চরকা টি আজ আর আমাদের লেটার বক্সে অহরহ হানা দেয় না।আর তার সাথে বাড়ির ছোটদের চিঠি থেকে খুলে স্ট্যাম্প কালেকশনের চর্চাটাও লাটে উঠলো। আগে পোস্ট কার্ড, ইন ল্যান্ড লেটার আসতো এখন আর আসে না। তাই আজকাল রোজ সিড়ির গোড়ায় লেটার বক্সে আঙুল ঢুকিয়ে ঠক ঠক বাক্স নাড়িয়ে আওয়াজ দিই। কিন্তু পোস্টকার্ড আর আসে না। আজও আমার মানিকতলার বাড়ির পুরোনো পোস্টকার্ডে নন্দবাবু বা বিনোদবাবুর ছবি দেখলে দু-চোখে পানি নামে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
আমার কুঁদঘাটের মামাবাড়ির লাগোয়া মাঠের কোণে একটা বড় তেঁতুল গাছ, আর তার বাঁদিকে গেলেই আমাদের নেতাজী মেলার মাঠ। সেই মাঠের এক পাশে একটা বটগাছের তলায় আসতো কথকঠাকুর। সে ছিল বাগের হাট জেলার লোক। মাঝে মধ্যে ওপাড়ে যাওয়া পড়তো তার। মুজিব ইয়াহিয়া ইত্যাদির ফাঁকে পড়তো রামায়ণের কাহিনি। কৃত্তিবাস বিরচিত সপ্ত-কাণ্ডের এরূপ সুরেলা পাঠ আমার কানে লেগে আছে। দিদিমা স্নেহের বশে তাঁকে যখন বলতেন ‘ঠাকুর পো একটু সীতার আর রামের রাজ্য পাট ছেড়ে দিয়ে বনবাসে যাবার কথা কত্ত দিনি’। সেদিন কী আর আমরা বুঝতাম দিদিমা কেন কাঁদে? বুঝতাম না। আর আজ যখন বুঝি রামের রাজ্যপাট হারানোর ঘটনাকে আমার দিদিমা মিলিয়ে নিতেন ওপাড় বাংলা থেকে রাজপাট হারিয়ে আসার গল্পের সাথে-ততদিনে নরোত্তম দাস কথকের আনা গোনা সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আমাদের মত অনেকের ঠাকুরমা- দিদিমারা, কলকাতার ছেলে-পুলেদের ১৮৪৭ সনের ২০ আইন অনুসারে রেজেস্টারী করা, মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি দেওয়া, বঙ্গদেশ, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত রামসুন্দর বসাক কৃত আদি শিশুপাঠ্য বাল্য শিক্ষা থেকে পড়ে শোনাতেন –প্রভাত বর্ণন।
“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।।
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।
ফুটিল মালতী ফুল সৌরভ ছুটিলো।
পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল।।
গগনে উঠিল রবি লোহিত বরণ।
আলোক পাইয়া লোক পুলকিত মন।
শীতল বাতাস বয় জুড়ায় শরীর।
পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির।
উঠ শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ।
আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ।
আসলে তত দিনে বছরের শুরুতে নতুন বই, মলাটের কাগজ ঢুকে যেত ঘরে।এসব আজ আর শুনি না। আজ আর ঘরে ঘরে আধ বোজা চোখে শীতের সকালে শুনতে পাই না এই পাঁচালি ছন্দের প্রভাত বর্ণন। সেসব এখন বন্ধের তালিকাভুক্ত। আমার যেমন আজও মনে পড়ে আমাদের ওপেনটি বাইস্কোপ খেলার কথা। কী যেন বেশ একটা ছড়া কাটতাম মুখেমুখে। সে খেলা আমরা বড় হতে হতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু কটি কথা মনে আছে।
“ওপেনটি বাইস্কোপ,
রাইট টার্ন টেইস্কোপ।।
চুল টানা বিবিয়ানা।
ছাতুবাবুর বৈঠক খানা
লাট বলেছে যেতে
পানসুপারি খেতে
পানের ভিতর মৌরিবাটা
ইস্কাপনের ছবি আঁটা...”
গোটা কবিতা জুড়ে এক উনিশ শতকের কলকাতা।শীতের খেলার কলকাতা, হারিয়ে যাওয়া কলকাতা। পাখি ওড়ানো ছাতু বাবুর কলকাতা, তাস খেলা বিবির কলকাতা, লাট সাহেবের কলকাতা, আমাদের কলকাতা...
আর মনেই পড়ে না টগর বগর ঘি কচুরী খেলার কথা। লাটে উঠেছে ইকির মিকির চাম চিকির। এসব আজ আর মনে পড়ে না। ভাইপো ভাইঝিদেরও এসব খেলা আর খেলতে দেখি না। দিন কয়েকের ‘লুডো’ই বা আজ আর অলস দুপুরে খেলে ক’জন? সংখ্যাটা পুটেও দাঁড়াবে কি-না সন্দেহ।কলকাতার বুকে শুধু বাড়ি-ঘর নয় এসবও হল হেরিটেজ।
এই হিসেবে দেখতে গেলে বলতেই হবে যে কলকাতার ‘বন্ধ’ চর্চার উদাহরণ হল রাশি রাশি। সেবার ইন্ডিয়া ও ওয়েস্টইন্ডিজের মধ্যে খেলা শুরু হবে। শীত কালে বছরের শুরুতে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ। রেডিও চলছে। ভেসে এলো অজয় বসুর কণ্ঠ। বললেন ‘খেলা শুরু হবে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ইডেনের দাউ দাউ সবুজ।’ এই দাউ দাউ সবুজ কথাটা আজ এক বিরল শব্দ। রেডিওর সেই অনবদ্য বাংলা ধারাভাষ্য আজ আর কানে বিশেষ আসে না।সেই রেডিও শোনাও আজ কলকাতার হেরিটেজ বললে মন্দ হয় না।বছরের শুরুতে কলকাতার পট চিত্র আঁকতে গিয়ে এসব কথা ভিড় করে আসছে। আসলে একটা কথা ঘর- বাড়ি মানেই কেবল হেরিটেজ নয়। শত বর্ষের গল্প মানেই হেরিটেজ নয়। হেরিটেজ মানে এগিয়ে চলার দিনলিপি, যা স্মৃতির পটে ছবি এঁকে যায়। যা বলে যায় পুরোনো নেগেটিভ থেকেই ছাপ তোলা হয় নতুন ছবির।