শরদিন্দুর অসমাপ্ত ব্যোমকেশ-কাহিনি সম্পূর্ণ করেন নারায়ণ সান্যাল

এমন সব ঘটনা, যেগুলো পৃথিবীর ইতিহাস চিরকালের মতো পাল্টে দিয়েছে, তাকে নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিতে পছন্দ করতেন নারায়ণ সান্যাল। সেই লেখাদের না বলা যায় গল্প-উপন্যাস, না বলা যায় গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ কিংবা অন্য কিছু। যেমন ‘বিশ্বাসঘাতক’। এখনও কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তরুণদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয় বইটি। বহু মানুষ নারায়ণ সান্যালকে শুধু ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর স্রষ্টা হিসেবেই মনে রেখেছেন। আজ সেই বিরল প্রতিভাধর মানুষটির ৯৭তম জন্মবার্ষিকী।
নারায়ণ সান্যাল ১৯২৪ সালের ২৬ এপ্রিল কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের খাতায় অবশ্য নাম ছিল নারায়ণদাস সান্যাল। জন্মসূত্রে কৃষ্ণনাগরিক হলেও ছাত্রজীবনে ছিলেন মহানাগরিক। অর্থাৎ কলকাতার বাসিন্দা। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিই সম্পূর্ণ করেন। দেশের সেবা করার ইচ্ছে নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকেই চলেছে সাহিত্যচর্চা।
বিদেশি লেখকদের রচনার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাতে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সাহিত্য রচনার নেশা তাঁর ছিল। স্ট্যানলি গার্ডেনারের তৈরি করা চরিত্র পেরি ম্যাসনের অনুসরণে তিনি দুঁদে উকিল পিকে বাসুকে সৃষ্টি করেছিলেন। কাঁটা সিরিজের উপন্যাসগুলো এখনও শিহরিত করে পাঠকদের। আসলে নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে লিখে মানুষকে চমকে দিতে ভালোবাসতেন। প্রচুর মৌলিক বই লিখেছেন। যেমন ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’, ‘প্রবঞ্চক’, ‘অন্তর্লীনা’, ‘নেতাজি রহস্য সন্ধানে’, ‘রোঁদ্যা’, ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’।
আরও পড়ুন: ‘আমাকে সেই কবিতালোকে উদ্ভাসিত করো’
দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা তাঁকে খুবই পীড়িত করত। ‘অরণ্যদণ্ডক’, ‘বল্মীক’, ‘বকুলতলা পিএল ক্যাম্প’-এর মতো বইগুলি সেই নিয়েই লেখা। ঐতিহাসিক কাহিনিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন ‘মহাকালের মন্দির’, ‘হংসেশ্বরী’, ‘আনন্দ স্বরূপিনী’ এবং আরও কয়েকটি গল্প-উপন্যাসে। স্থাপত্য হোক বা মনোবিদ্যা, চিত্রকলা হোক বা পদার্থবিদ্যা – সব বিষয় নিয়েই প্রাঞ্জলভাবে লেখার অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। ‘মনামী’, ‘লাডলী বেগম’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রভৃতি বই পড়লেই মালুম হয়, সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছেন নারায়ণবাবু।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে একটি লেখা অসমাপ্ত রেখেই মারা যান, তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন নারায়ণ সান্যাল। সেই ‘বিশুপাল বধ’-এর শেষ অংশটি পড়তে গিয়ে কিন্তু একবারও হোঁচট খেতে হয় না। শরদিন্দুর হুবহু অনুকরণ নেই, নারায়ণ সান্যালের ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতী আলাদা করে ছুঁয়ে যায় ব্যোমকেশভক্তদের মন।
রবীন্দ্র পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কারের মতো বিভিন্ন সম্মাননায় নারায়ণ সান্যাল ভূষিত হয়েছেন। ২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় তাঁর। বাংলার এলিট মহলে তিনি আজও খানিকটা উপেক্ষিত কিংবা অনুচ্চারিত। যদিও তরুণ পাঠকদের তিনি নয়নের মণি। নানা রঙে রঙিন এই ছকভাঙা ব্যক্তিত্বের জন্মবার্ষিকীতে রইল বঙ্গদর্শনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।