সাকিন চেনা যায় বাসের নম্বরে

এই রাজ্যের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র শহর কলকাতা, যেখানে সরকারি বাসের নম্বর দিয়ে আজও এলাকার নাম চিহ্নিত করা আমাদের অভ্যাস। এর সঙ্গে অবশ্য উনিশ শতকের নবজাগরণের কোনো সম্পর্ক আছে এমন নয়। সুদীর্ঘ বিদেশি শাসনের নিদর্শন কলকাতার পথঘাটের নামগুলি, যা হাজার চেষ্টা করে ভিন্ন নামে চিহ্নিত করেও মানুষের মুখের কথা থেকে মুছে ফেলা যায়নি। কিন্তু বাসের নম্বরের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এলাকার নামের পেছনে যে সংস্থাটির অবদান সেটি অধুনালুপ্ত কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিগম বা সিএসটিসি। স্বাধীনতা-উত্তর কলকাতাকে কেন্দ্র করে উদ্বাস্তুর নিরন্তর চাপ কার্যত কলকাতার জনবিন্যাসকে চরিত্র বদলে দেয় আর সেই বাড়তি মানুষগুলোর সামনে সবচেয়ে দরকারি ছিল সম্মানজনক জীবিকা। কিন্তু এত মানুষের চটজলদি জীবিকার সংস্থান করা বড়ো সহজ কাজ নয়। তার ওপর কেন্দ্রের নেহেরু সরকার বরাবরই ছিলেন বাঙালির প্রতি বিরূপ, উপরন্তু ভিটেমাটিহারা ওই বিপন্ন জনগোষ্ঠী কংগ্রেস দল বা কোনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধামা না ধরে প্রত্যক্ষভাবে শরিক হয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতির যা ছিল চাচাজির নিতান্ত অপছন্দের।
আরও পড়ুন
লিটল ম্যাগাজিনের জন্যই বেঁচে থাকা যাঁদের
এই অবস্থায় বিধান রায় মূলত বাঙালি উদ্বাস্তু যুবকদের জীবিকা ও পুনর্বাসনের কথা বিচার করে সিএসটিসি-র কথা ভাবেন যা নাকি কলকাতার গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও একটা ভূমিকা নিতে পারবে, অন্যদিকে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের একটা উপায় হিসেবে গণ্য হবে। এইসময়ের আগে কলকাতার গণপরিবহন মূলত নির্ভরশীল ছিল ব্যক্তিমালিকানার বাসের ওপর যার চালক ও কন্ডাক্টার ছিলেন মূলত অবাঙালি। কথাটা এই বাঙালি অবাঙালি নিয়ে নয়, ভাববার কথা এটাই যে এই সরকারি বাস পরিষেবা সাধারণ নাগরিকের কাছে কীভাবে জনপ্রিয় ও গ্রাহ্য হয়েছিল, যার প্রমাণ ওইসব কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া বাসের রুটগুলি। যেমন আমাদের ছেলেবেলায় আমরা শুনতাম সারা কলকাতা ঘুরে দেখার জন্য নাকি আদর্শ হল এইটবি বাস আর তার দোতলার সিট পেলে তো কথাই নেই। একটু বড়ো হয়ে যখন সেই বাসে চেপেছি, সত্যিই তো হাওড়া স্টেশন ছেড়ে রবীন্দ্র সেতু পেরিয়ে দক্ষিণগামী সেই বাস অনায়াসে ধরে নেয় উত্তরের রাস্তা। গিরিশ পার্ক, মানিকতলা, শিয়ালদহ, বেকবাগান হয়ে সে অবশেষে পৌঁছায় যাদবপুরে। মজার ব্যাপার, সেই এইটবি বাসের রুট বহুকাল বিলুপ্ত হলেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ওই বিশেষ অঞ্চলটি এখনও এইটবি বলেই পরিচিত – ওই একটি নম্বর বললেই আমরা বুঝতে পারি আসলে কোন এলাকার কথা বলা হচ্ছে। উত্তর শহরতলির এমনই দুটো পরিচিত জায়গা হচ্ছে এগারো নম্বর আরএলনাইন। বিটি রোডের ওপর রথতলা মোড় ছেড়ে একটা টারমিনাস থেকে একদা এগারো নম্বর রুটের একটি সরকারি বাস হাওড়া স্টেশন যেত – সেই বাস ও রুট এখন বিলুপ্ত, কিন্তু তাতে জায়গাটির নামের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একই কথা খাটে ডানলপের মোড় পেরিয়ে আসা এলনাইন এলাকাটি সম্বন্ধে, যার সঙ্গে জুড়ে আছে উত্তর দক্ষিণের যোগাযোগকারী এলনাইন বাসের রুট। যা চলাচল করত গোলপার্ক থেকে ডানলপ পর্যন্ত – সেই রুটও আজ উধাও। কিন্তু লোকমুখে শুধু নয় এলাকার দোকানের সাইনবোর্ডে অবধি ঠিকানা লেখা থাকে একটিমাত্র বাস রুটের নম্বর,এল নাইন।
আরও পড়ুন
দুই দেশের দুই লৌহ যবনিকার গল্প
ভেবে দেখছি, এই এলাকার চিহ্নিতকরণের আরো কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দৃষ্টান্ত হতে পারে দমদম স্টেশন সংলগ্ন এগারোএ, পাইকপাড়ার টুবি (যে বাস নিয়ে স্বয়ং শিব্রাম কলম ধরেছেন), আছে বেহালার চোদ্দ নম্বর, ঠাকুরপুকুরের বারো ডি, গড়িয়ার পাঁচ/ছয় নম্বর, কাকুড়্গাছির থ্রিএ, উল্টোডাঙ্গার নয় নম্বর যার উল্লেখ পাই শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত’-এ। বলা বাহুল্য এইসব বাসরুট কোনোটাই আজ আর চালু নেই। কার্যত সাধারণ রুটের সরকারি বাস এখন আর শহরে চলে না, যা চলে তাদের সবারই আগে এস বা এসি বা কেপি ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। সে অবশ্য এক এক ভিন্ন অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর হারিয়ে যাওয়া বই
তবে সন্দেহ নেই, সমাজতাত্ত্বিকভাবে এই বিষয়টা এক অন্য ভাবনার প্রান্তকে জাগিয়ে তোলে। এর সঙ্গে মিলেমিশে আছে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে মানুষের জড়িয়ে থাকার এক অনবদ্য উদাহরণ। সরকারি অর্থে গঠিত কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিগম শুধু স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন তাই নয়, বৃহত্তর কলকাতার মানুষ এই সরকারি পরিষেবা সানন্দে ব্যবহার করেছেন ও তাকে লালন করেছেন। এইসব ঘটনার অনেক পরে পরিকল্পনা কমিশন আমাদের অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা (participative planning) এর ধারণা দিয়েছে, আমরা সরকারি পরিকল্পনার বৃত্তে সেইসব তত্ত্বের চাষবাস করেছি। হয়তো তাতে তেমন সাড়া জাগাতেও পারিনি। কিন্তু ঢের আগে সিএসটিসি তাঁদের পরিষেবার মাধ্যমে আমজনতার জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছেন, গণপরিবহনের ক্ষেত্রে যে উদাহরণ প্রায় বিরল। আরো বিরল এই কারণে গত কয়েক দশক ধরে আমরা কেবলই সরকারি উদ্যোগকে সন্দেহ করতে শিখেছি আর সেই সন্দেহকে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্ত তাত্ত্বিক ডিসকোর্সকে প্রায় একরকম অবান্তর করে দিয়ে একদল কর্মী মানুষকে সরকারি ছাতার তলায় সুষ্ঠু পরিষেবা জুগিয়ে গেছেন, স্বচ্ছন্দ গতির নিশ্চিত নিরাপত্তায় মানুষ বেসরকারি বাস ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সরকারি বাস, তুলনায় যাআরামপ্রদ। মুখে মুখে সেইসব বাসের রুট কিংবদন্তী হতে হতে এলাকার সাবেকি নামের বিকল্প হয়ে উঠেছে! সিএসটিসি আজ ইতিহাস। সুন্দরবনের বাঘের মতোই সেই বাঘের মুখের ছাপ দেওয়া বাসগুলি আজ বিলুপ্ত কিন্তু মানুষের মুখে মুখে ফেরা সেইসব রুট আর তার স্থান মাহাত্ম্য এখনও উজ্জ্বল। স্মৃতি সতত না হলেও কখনও কখনও বসন্ত বাতাসের মতো স্নিগ্ধ।