No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বারোমাস্যা পিঠা- নকশি পিঠা

    বারোমাস্যা পিঠা- নকশি পিঠা

    Story image

    “অঘ্রাণে নবান্ন উৎসবে পড়ে চিড়া-পিঠার ধুম
    পুঁথি পাঠ আর গল্পের আসর কেড়ে নেয় ঘুম।”

    খুব বেশি আগিলা দিনের কথা না। তিন-বারো ছত্রিশ মানে তিন যুগ আগে যখন বিজলিবাতির চমক ছিল না। তখনকার নবান্নের দিনকাল ‘ধুম’ আর ‘ঘুম’ এর মধ্যে এ করকম আয়াসেই কাবার হইতো। কিন্তু যখন থেইকা টেলিভিষণ এর লগে জি, স্টার, তারা, জলসা ইত্যাদি বিনা রক্তপাতে বাঙালের প্যাঁক কাদার বন্য জগতের ঘরের দাওয়া, বৈঠকখানা, শোয়ার কিংবা ঠাকুরঘরের দখল নিয়া নিল সেই দিন থেইকা বেবাক ‘ধুম’ আর ‘ঘুম’ এর জায়গায় ‘সিরিয়াল’ পড়ল। হরেক পদের ‘সিরিয়াল’ চাখতে চাখতে নবান্নের হিসাবে গড়মিল এখন! তার পর ও এখনও বাংলায় ষড়ৈশ্বর্যের পালায় নবান্ন আসে। আগের মত আটপৌরে জীবনের পাঞ্জেগানা আমলনামা না থাকলেও এখনও আবেগে টান পড়লে চালগুড়ির তলব হয়। যা হাল আমলের পিঠা পিস্টকের তলবি সভা গোছের!

    গত শতাব্দীর শত্তুরের শেষ আশির শুরুর আমার দেখা চেনা গাও গেরামের খাঁ, ভূঁইয়া, তালুকদার বাড়িতে ফুল গাছের খুব একটা চোখে পড়ত না। কিন্তু রায়, শীল, দাস, সাহা, বৈরাগী বাড়িতে যা ছিল অবারিত। কিন্তু মোদের বাড়িতে গাছের ফুল না থাকলেও নাকফুল, খোঁপায় ফিতার ফুলের (আসলে যা গিট্টু) লগে ‘ফুল পিঠা’ও আছিল। ফুলের চর্চা আরও ছিল রুমালে, বালিশের ওয়ারে, দস্তরখানে। শ্রীযুক্তদের বাড়িতে বাড়তি ছিল সন্দেশের সাঁচে কতই না বাহারি ফুলের নকশার আনাগোনা।

    ‘ফুল পিঠা’ যা আসলে ‘নকশি পিঠা’। ‘মমিনসিঙ্গারা’ কয় ‘পাক্কোন’ বা পাকোয়ান পিডা। যা ক্রমশ ব্রহ্মপুত্রের  জলের লগে ভাটিতে আইসা দক্ষিনে ঢাকার একটা অংশে নাম লইলো ‘ফুল পিডা’। প্রমিত বাঙলা কতায় ‘ফুল পিঠা’ বা ‘নকশী পিঠা’। ঘরে তৈরি 'নকশী পিঠা' হঠাৎ উপস্থিত ‘কুটুম’ থেকে বরযাত্রী আপ্যায়ন পর্যন্ত হাজিরা দিত। খাওয়ার বস্তু দিয়েও অন্দরমহলের শিল্প চাতুর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার একটা যুতসই মওকা তৈরি করে দিত এই ‘নকশি পিঠা’। এই এক বারোমাস্যা পিঠা। কুটুমবাড়ি নাইওরে তত্ত্ব হিসাবেও যার কদর।

    নকশি পিঠার উপকরণাদি:

    আতপ চালের গুড়া, কলা পাতা, রুটি বেলার বেলুন, পিড়ি, তেল, খেজুর কাঁটা, সূঁচ, পাট শলা, বাঁশের নেইল।
    পদ্ধতি:

    চালের আটা সেদ্ধ জলে গুলে কাই করে বেলুন দিয়ে পুরু করে রুটি তৈরি করে তার উপর নকশা করা হয়। নকশা করার জন্য পাট শলা, সুঁচ, খেজুর কাঁটা, বাঁশের নেইল ব্যবহার করা হয়। পাট শলা, সূঁচ দিয়ে নকশা এঁকে খেঁজুর কাঁটা ও সূঁচের ঘায়ে কেটে খোদাই করে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। তার পর গরম তেলে হালকা ভেজে পিঠা রোদে শুকাতে হয়। পর পর কয়েকদিন চড়া রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে তা মুখ আঁটা পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। যেহেতু ভালো ভাবে শুকানো তাই দীর্ঘ দিন তা সংরক্ষণ করা যায়। তবে তা স্যাঁতস্যাঁততে পরিবেশ থেকে অপেক্ষাকৃত শুকনো স্থানে রাখতে হয়। অতঃপর প্রয়োজন অনুযায়ী সেই পিঠা আবার ডুবা তেলে ভেজে হালকা খয়েরি রঙ ধারণ করলে তেল থেকে তুলে গুড় বা চিনির সিরাতে ডুবিয়ে ভিজিয়ে রেখে তারপর তুলে পরিবেশন করা হয়। সিরা থেকে তুলে এই পর্যায়েও নকশী পিঠা বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করা যায়।

    সত্যি বাঙালির জীবনাচরণে শিল্পের বসতি। অতি সামান্যে হলেও খায়, শোয়, ঘুমায়, বাঁচে এই শিল্পে। নকশার শিল্পে। যার আবার সিংহভাগটা জুড়ে আছে রমণীয় উপস্থিতি, উদ্ভাস। পরম্পরা জ্ঞানের উজ্জ্বল দীপ্তি। কিন্তু একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলার লোকমানসের সংস্কৃতি গবেষণায়, আলোচনায় মোটের উপর আর যাই হোক না কেন খাদ্য বস্তু নিয়ে আয়োজনের দ্বীনতার খামতি নেই।

    বাঙালির জীবন্ত শিল্প ভাণ্ডারের উজ্জ্বল উপস্থিতি এই নকশি পিঠা। স্নেহমমতাপূর্ণ, কল্পনাপ্রবণ এই নকশা ব-দ্বীপের আয়ুস্কর মাটি থেকে উত্থিত। এর আকর্ষণীয় রৈখিক ভঙ্গি বিন্যাস ইমেজের আকর্ষণীয়তায়, স্বপ্ন ও বাস্তবতায় জীবনের নান্দনিক আয়াসেরই সারাংশ।

    বাংলার স্বতন্ত্র ও একমাত্র এই নকশী পিঠা’র নকশার ঘরানা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করে। উত্তরভারতের যেমন মার্গ সঙ্গীত কালোয়াতি গান, তেমনি বাংলার আলকাপ, গম্ভীরা ঠিক তেমনি নকশার বেলায় ঢাকায় জামদানি, মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ি, কুমিল্লার খাদির মত ঢাকা ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘নকশি পিঠা’, মেদিনীপুরের গয়না বড়ি। ‘নকশী পিঠা’ ইদানিং শহুরে দোকানে মার্কেটে বিক্রি হলেও তা বিক্রির জন্য কেউ তৈরি করত না। ‘নকশি পিঠা’ আমাদের ঘরের বস্তু। ঢাকা ময়মনসিংহ অঞ্চলের পিঠাই ঘরানা। প্রিয়জনকে তুষ্ট করবার জন্য, তাদের প্রশংসা পাওয়ার জন্য বাড়ির মেয়েরা অসীম ধৈর্য্যে অপরিসীম মনোযোগ ও পরিশ্রমে ‘নকশি পিঠা’ তৈরি করেন। এ রীতিমত এক আয়োজন। তাৎক্ষণিক এ আয়োজন থেকে খাওয়ার জন্য এ বস্তু পাতে ওঠে না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রহরের পর প্রহর। একেকটা ধাপ পেড়িয়ে তবেই তা রসনার জন্য প্রস্তুত হয়। সূঁচ দিয়ে কাঁথা সেলাই, পিটুলিগোলা দিয়ে আলপনা যেমন মমতায় দেয়া হয় তেমনি ভালবাসায় শিল্পবোধে তাঁরা পিঠায় নকশা ফোটান। নিজের হাতে তৈরি খাবার খাইয়ে তাঁরা খুশি হন। আমাদের মায়েরা এমনই  হয়ে থাকেন। তাঁদের অন্তরের ভালবাসা এবং মমতার গুনেই সামান্য চালগুড়ির তৈরি পিঠা অসামান্য শিল্পবস্তু হয়ে উঠতে পারে।

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @