ছুঁচ-সুতোয় গল্প বোনা আছে যে সংগ্রহশালায়

'ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা / সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা |' জসমিউদ্দিন তাঁর কালজয়ী কাব্যোপন্যাসে প্রাধান্য দিয়েছিলেন 'কাঁথা' শব্দটিকে, গড়েছিলেন এক মায়াবী জগত। শুধু সুতো আর কাপড়ের কাজ তো নয়, কাঁথার অর্থে নিহিত আছে গ্রামবাংলার মা-ঠাকুমাদের সান্নিধ্য, বনস্পতি, নরম আদর। সেই জন্যেই তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও নিজের কবিতার বইয়ের নাম রেখেছিলেন 'পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি'। বাংলায় কাঁথাশিল্পের ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশি সময়ের। পুরনো শাড়ি, আরও নানা ধরণের কাপড় স্তরে-স্তরে সাজিয়ে সেলাই করে যে বস্তু তৈরি হয়, তাকেই কাঁথা বলা হয়। ঘরের মহিলাদের হৃদয়বৃত্তি, তাঁদের ভাব-ভালোবাসা, আকাঙ্খা সবই অভিনব সুতোর কাজে প্রকাশ পায় কাঁথাশিল্পে।
কাঁথা অনেক ধরণের হয়, যেমন সুজনি, লেপ, নক্সী, ওয়াড় ইত্যাদি। কিন্তু নির্দিষ্টরূপে নক্সী কাঁথার সাথে যে প্রেমময়তা আছে, গঞ্জহাট আর ঘর-অলিন্দের যে প্রবাহ আছে, তা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত নক্সী কাঁথাকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহরেই আছে এক অভূতপূর্ব সংগ্রহশালা। উত্তর-মধ্য কলকাতার ফুলবাগান থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ - আম্বেদকর ভবন। সেই ভবনের একতলাতেই এই সংগ্রহশালা, যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কালচারাল ইন্সটিটিউটের অধীনে। দুর্ভাগ্যজনক যে এই সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম সম্বন্ধে জানেন এমন মানুষের সংখ্যা বেশ কম। ফলে দর্শকের অভাবে জায়গাটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। তবে এই মুহূর্তে এইসব কথা কিছু দূরে সরিয়ে রেখে কাঁথাশিল্প এবং এই অসাধারণ সংগ্রহশালাটিকে নিয়ে কয়েকটা কথা বলা যাক।
বহু যুগ ধরেই এই শিল্পের কদর আছে, যা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যখন জানতে পারি শ্রী শ্রী চৈতন্য কথামৃতের মতন প্রাচীন গ্রন্থেও 'কাঁথা' শব্দটির উল্লেখ আছে। উল্লেখ করেছেন সেই সময়ের স্বনামধন্য সংস্কৃত পণ্ডিত কৃষ্ণদাস কবিরাজ। সংগ্রহশালার একই নোটিসবোর্ডে এই তথ্যটি পাওয়া যায়।
নক্সী কাঁথা সেলাই করা হয় ভাবনার একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে, যাকে ইংরেজিতে বলে 'ফোকাল পয়েন্ট'। কারুকাজের ক্রমশ বিস্তার হয় সেই কেন্দ্রবিন্দুকে মাথায় রেখে। বলা যেতে পারে সেই 'ফোকাল পয়েন্টই' নক্সী কাঁথার কাজে চালিকা শক্তি। উদাহরণস্বরূপ অনেক নক্সী কাঁথার সেলিয়ায়ের কাজ শুরু হয় একটি পদ্মফুলকে কেন্দ্রবিন্দু ভেবে। প্রথমেই কাপড়ে সেই ফুলটি ছুঁচ-সুতোর নিপুণ কাজে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী। তারপর সেই ফুলটিকে ঘিরে লতাপাতা, জলধারা ইত্যাদি সেলাই করে ক্রমশ ফুটিয়ে তোলা হয়, বাস্তবিক নক্সীর কাজে জীবন্ত হয়ে ওঠে কাঁথা। তবে শিল্পীদের ভাবনার স্রোত আরও দূর্বার। শুধু ফুল, লতাপাতা নয়, নক্সী কাঁথায় গ্রামবাংলার সম্পূর্ন চিত্রও সুন্দরভাবে ধরা থাকে। সেই ছবিতে জলে মাছ থাকে, আকাশে পাখি, ক্ষেতজাঙালের পথে হাল কাঁধে চাষী, নরম কাপড়ের ঢেউয়ে থাকে লোকজ প্রাণ।
সংগ্রহশালাটির প্রধানতম উদ্দেশ্য হল বাংলার কাঁথাশিল্পকে উজ্জীবিত করা। এই সূত্রে শিল্পীদের স্বীকৃতি দেওয়া, তাঁদের জীবিকা নির্বাহের কাজে পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি কাজ পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই সুষ্ঠুভাবে করছে। মিউজিয়ামটি ঘুরিয়ে দেখান আধিকারিক শম্পা চন্দ সিন্হা। তিনি বঙ্গদর্শনকে মার্কিন শিল্প ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামিজের কাঁথাপ্রীতি নিয়ে বলেন। স্টেলা ক্রামিজ বাংলার কাঁথাশিল্পকে একটি উচ্চমানের শিল্প হিসেবে দেখেন। ওনার কথা অনুযায়ী, এই শিল্পমাধ্যমে বাংলার নারীদের অদম্য প্রাণশক্তি আর কল্পনাপ্রবণতা নিখুঁতভাবে প্রকাশ পায়। সংগ্রহশালায় একটি কাঁথার বয়স দেড়শো বছরেরও ওপরে। আয়তনে প্রায় ৬ ফিট বা ৫ ফিট। স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে সেই কাঁথা থেকে আজও বিচ্ছুরিত হয় মানুষের চলাচল, হাওয়ার বয় যাওয়া, নদীর গান। স্বপ্না খাতুন, পুতুল দাস, মাসুদা সুলতানা, সীমা লোহারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ছবি ফুটে উঠেছে এই মিউজিয়ামের বেশ কিছু কাঁথায়। অন্য এক শতাব্দীর মা-দিদিমাদের প্রশ্রয় পেতে হলে এই সংগ্রহশালাটি ঘুরে আসতে পারেন, নিরাশ হবেন না।