মৃত্যু নিয়ে মেয়ের রসিকতা দেখে অলক্ষ্যে হয়তো মুচকি হেসেছিলেন রাধারাণীও

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে একটা অদ্ভুত বিষয় নিয়ে বিতর্কসভা বসেছে। ‘ডিভোর্স উচিত কি না’। বিপক্ষে বলবেন অনুরূপা দেবী আর পক্ষে রাধারাণী। আজ থেকে একশো বছর আগের মহানগরীতে অনেক সম্পন্ন ঘরেও ডিভোর্স শব্দটি অচেনা। অথচ, সেদিন বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন রাধারাণী। তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ নাড়িয়ে দিয়েছিল শ্রোতাদের।
যাঁরা রাধারাণীকে চিনতেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অবাক হননি তাঁর সেই বক্তব্যে। আশ্চর্য এক নারী। মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে। সংসার কী— তা-ই তখন বোঝে না ছোট্ট মেয়েটি। বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এশিয়াটিক ফ্লু-তে চলে গেলেন স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ। বাল্যবিধবা রাধারাণীকে মেয়ের মতো বুকে টেনে নিয়েছিলেন শাশুড়ি সুশীলাবালা দত্ত। তিনিও এক অমল মানুষ। রাধারাণীর লেখার প্রথম শ্রোতাও তিনিই। রাধারাণী বড়ো হতে লাগলেন ধীরে ধীরে। লেখালিখির সংখ্যা বাড়তে লাগল। পরিচিতিও বাড়তে লাগল পাঠক সমাজে। ‘কাব্য-দিপালী’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন নরেন্দ্রনাথ দেব। সেই কাজে সাহায্য করতে গিয়েই তাঁকে মন দিয়ে বসলেন রাধারাণী। প্রেম অবশ্য দ্বিপাক্ষিক। এর চার বছর পর দু’জনের বিয়ে। নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করেছিলেন রাধারাণী। পরের দিন একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল, ‘রাধারাণী-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান’! রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছিল বাংলার রক্ষণশীল মহলে। কিন্তু, নবদম্পতীকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীরা।
সে-যুগে রাধারাণী সত্যিই ব্যতিক্রম। ১৯২৯-এ প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লীলাকমল’। একদিন এক আড্ডায় প্রমথ চৌধুরী বলে বসলেন, “আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠলো না।... মেয়েরা কেন এমন লেখা লিখবে না, যে-লেখায় লেখকের নাম না থাকলেও কারুর বুঝে নিতে ভুল হবে না এ লেখা মেয়ের। পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়, ঠিক এমনতর লেখবার।” কথাটা মানতে পারলেন না রাধারাণী দেবী। ঠিক করলেন, এর উত্তর দেবেন নিজের লেখাতেই। ক’দিন পরেই আত্মপ্রকাশ করলেন অপরাজিতা দেবী। বলা বাহুল্য, এ রাধারাণীরই ছদ্মনাম।
নতুন কবির আত্মপ্রকাশে পাঠকমহলে হইচই পড়ে গেল। কে এই লেখিকা? রহস্য বাড়ল অপরাজিতা দেবীর ‘পুরবাসিনী’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে রাধারাণী আর নরেন্দ্র দেবের নাম দেখে। অনেকে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, এই কবি নিশ্চিতভাবেই পুরুষ। প্রমথ চৌধুরী বললেন, এই কবিতা পুরুষের রচনা হতেই পারে না। মেয়েদেরই লেখা। ছদ্মনাম নেওয়া ততদিনে সার্থক হয়েছে রাধারণীর। নিজের লেখার সূত্র ধরেই প্রমথ চৌধুরীকে উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে তাঁর।
দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে জমি কিনে ‘ভালো-বাসা’ গড়লেন নরেন্দ্র দেব। ততদিনে প্রথম সন্তানকে খুইয়েছেন দুজনেই। জন্মের কয়েকদিন পরেই সেই ছোট্ট শরীরের প্রাণ নিভে গেছে। ভেঙে পড়ছে রাধারাণীর শরীরও। তাই নতুন বাড়িতে আলো-বাতাস খেলার পর্যাপ্ত অবকাশ রেখেছিলেন নরেন্দ্র। দুঃসময় কেটে গেল। কোল আলো করে এল দ্বিতীয় সন্তান ‘খুকু’। শরৎচন্দ্র তখন শেষ শয্যায়। সেখান থেকেই রাধারাণীর মেয়ের জন্য একটি নাম রাখলেন-- ‘অনুরাধা’। এর তিন দিন পরেই শরৎচন্দ্রের মৃত্যু। কিন্তু, মেয়ের নাম অনুরাধা রাখা হয়নি রাধারাণী-নরেন্দ্রর। বরং, স্থায়ী হল রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নামটাই। নবনীতা।
মা এমন বলেই হয়তো আকাশ ছুঁতে পেরেছিলেন নবনীতা। মা আজীবন তাঁর বন্ধু, পথপ্রদর্শক। মেয়ের হাতে কবিতা লেখার ডায়েরি তুলে দিয়েছেন তিনিই। নবনীতার প্রথম কবিতা ‘চলচ্চিত্ত’-র নামকরণটিও তাঁরই করা। মেয়ে প্রেমে পড়েছে শুনে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রেমিককে ‘ভালো-বাসায়’ আনতেই হবে। যাদবপুরে যখন পড়ছেন নবনীতা, রোজ তাঁর থেকে পড়াশোনার হদিশ নিতেন রাধারাণী। একদিকে মেয়ের পড়া ঝালিয়ে নেওয়া, অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করা—দুইই হত একসঙ্গে।
কেমব্রিজে অমর্ত্য-নবনীতা বিয়ে সারলেন, তারপর গেলেন ঘুরতে। মাকে লিখে পাঠালেন সেই অভিজ্ঞতা। ফেরার পর অমর্ত্য পেলেন রাধারাণীর টেলিগ্রাম। তাতে লেখা, ‘এনজয় ইওরসেলভস। ডোন্ট সেন্ড পোস্টকার্ডস!’ এমন রসিকতা কি সবাইকে মানায়? রাধারাণীকে মানাত অবশ্যই। মেয়েকেও নিজের পথে দৃঢ়ভাবে চলতে শিখিয়েছেন তিনিই। প্রয়োজনে তিন তলার ঘর থেকে দোতলায় মেয়েকে নোট পাঠিয়েছেন। সাহস জুগিয়েছেন। জীবনকে দুহাত ভরে গ্রহণের মন্ত্র মায়ের থেকেই পেয়েছিলেন নবনীতা। বলেছিলেন, “মায়ের কথা ভেবেই সকাল হয়।”
মায়ের মতো দাপট নবনীতারও ছিল বৈকি। নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তাঁকে দেখা করাতে নিয়ে গেছেন তপন রায় চৌধুরী। নীরদ চন্দ্র প্রশ্ন করলেন, ‘কী করা হয়?’ নবনীতার উত্তর-- ‘কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পড়াই।’ বাকিটা তপন রায় চৌধুরীর বয়ানেই শোনা ভালো—
“‘ওটা একটা ধাপ্পা ! কোথায়?’ ‘যাদবপুরে।’ ‘ওটা আর একটা ধাপ্পা।’
এবার জোড় হস্তে নবনীতা বললেন, ‘একটা কথা বলতে পারি? আপনার অপরিসীম পান্ডিত্য। তার সঙ্গে কোনওভাবেই আমাদের তুলনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ষোলো বছর বয়স থেকে এই কুড়ি বছর হল আমি তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছি। এটাই আমার জীবিকা। যদি বলি এই একটা বিষয় আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি, খুব কি অন্যায় বলা হবে?’ এর পর আলোচনা আর বেশি এগোয়নি। পরে দেখা হলে উনি বললেন, ‘মেয়েটা দজ্জাল, না?’ আমার উত্তর, ‘সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’ ...”
রাধারাণী চলে গেছিলেন ৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে। কোমায় চলে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “গুড বাই”। ঠিক তিরিশ বছর পরে হেমন্ত সন্ধ্যায় যখন চিরতরে নিভে যাচ্ছেন নবনীতা, তাঁর আগে লিখে গেছেন ‘কামেন ফাইট’। রসিকতা করেছেন মৃত্যুসম্ভাবনা নিয়ে, নিজের শরীরে বাসা বাধা ক্যানসার নিয়ে। তারপর চলে গেছেন রাজকীয় নৈঃশব্দ্যে। মৃত্যুকে এমন ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া দেখে অলক্ষ্যে হয়তো মেয়েকে কুর্নিশ জানিয়েছেন রাধারাণীও।
ঋণ: অপরাজিতা রাধারাণী, পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ মে, ২০১৯; রাধারাণী দেবী, রত্না মিত্র, অভিষেক ঘোষাল।
ছবি: অন্তরা দেব সেনের ফেসবুক পেজ থেকে।