শোভাবাজার নামের আড়ালে কোন ‘শোভা’?

একদিকে কুমোরটুলি, হাটখোলা, বেনিয়াটোলা, বাগবাজার এবং শ্যামবাজার। সামান্য দূরেই দর্জিপাড়া ও গরানহাটা। এরই মাঝে, কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে রাজকীয় বিলাসে বিছিয়ে শোভাবাজার। সাবেক কলকাতার গন্ধ এখানে আজো পায়চারি করে। হাতিবাগানের গা লাগোয়া গ্রে স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির (এককালের চিৎপুর রোড) মাঝখানে নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিট ধরে হেঁটে বেড়ায় সেইসব বিগত দিনের গল্পেরা। নবকৃষ্ণ দেবের প্রতিষ্ঠা করা বিখ্যাত রাজবাড়ি এই রাস্তাতেই। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভের বিশেষ উদ্যোগে কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোটি হয়েছিল এখানেই। পাশেই কালিকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ি। দু’দুখানা রাজবাড়ি, কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোর ইতিহাস-- শোভাবাজারের বনেদিয়ানার শোভাটি সামান্য নয়।
অথচ, শোভাবাজার নামে জুড়ে থাকা ‘শোভা’ খুবই প্রতারক একটা অংশ। বিখ্যাত কলকাতাবিদ-ঐতিহাসিকরা বলেন, এই নামের সঙ্গে নাকি ঘোরতর যোগ রয়েছে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। আর কেউ কেউ সেই প্রস্তাব উড়িয়ে বলেন, না নবকৃষ্ণ নয় এই নামের আড়ালে রয়েছেন শোভারাম বসাক।
১৬৯০ সাল। জোব চার্নকের বিশাল নৌকো এসে ভিড়ল কলকাতায়। নগর পত্তনের জন্য গঙ্গার পাশে এই অংশটাকেই মনে ধরেছিল তাঁর। প্রথমে ভেবেছিলেন গঙ্গার ওইপারে উলুবেড়িয়ায় শহর বসাবেন। কিন্তু, নানা কারণে সে পরিকল্পনা বাতিল হল। তারপর, কলিকাতা-সুতানুটি ও গোবিন্দপুর মিলে জন্ম নিল শহর কলকাতা। তখন কিন্তু শোভাবাজার নামটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বরং তার পরিবর্তে ছিল ‘পাবনা-বাসনা’ নামের একটি বেহদ্দ গ্রাম। সুতানুটির অন্তর্গত অবশ্যই। কিছুদিনের মধ্যেই এই অঞ্চলে প্রতিপত্তি বাড়ল হুগলির আদিসপ্তগ্রাম থেকে আসা বসাক তথা বসুক ও শেঠদের। সুতানুটির হাটে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে তাঁরা তখন বেশ নামকরা ধনী।
শোভাবাজার রাজবাড়ি
এই বসাক বংশেরই একজন বিখ্যাত পুরুষ শোভারাম বসাক। তৎকালীন কলকাতার বিশিষ্ট ধনী। ইংরেজরাও যথেষ্ট খাতির করে চলত তাঁকে। নেহাত খুব কম নাম-ডাক-সম্মান ছিল না তাঁর। নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন ইংরেজদের মুনশি। ‘রাজা’ উপাধিও ইংরেজদেরই প্রদত্ত। সাহেবদের খিদমতগারি তাঁর বাধ্যতামূলক পরিণতি। এমনকি, পলাশির যুদ্ধে তিনি নাকি সিরাজদৌল্লার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থাৎ, ইংরেজদের পক্ষে। তার পুরস্কার-স্বরূপ লর্ড ক্লাইভও তাঁকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন নানাভাবে। অথচ, শোভারাম বসাকের সঙ্গে কিন্তু এমন ইতিহাস লেপ্টে নেই। তিনি বেজায় ধনী, ব্যবসা-মুনাফা তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। কিন্তু, সিরাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ শাসনকে এদেশের ভবিতব্য করে তোলার মতো কোনো ঘটনায় অন্তত কোনো ভূমিকা ছিল না তাঁর।
এহেন শোভারাম বসাকের বিখ্যাত সুতার হাটটি ছিল সুতানুটিতেই। অনেকে বলেন, এই সুতা-হাটাই কালক্রমে শোভারামের নামে শোভাবাজারে পরিণত হয়। কিন্তু, সেক্ষেত্রে ‘শোভারামবাজার’ হল না কেন? এই প্রশ্নের অবশ্য উত্তর নেই।
এই জায়গা থেকেই শোভাবাজার নামকরণের দ্বিতীয় মতটিকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন অনেকে। এই মতে, শোভাবাজার নামটি এসেছে ‘সভাবাজার’ থেকে। আর এই নামকরণের ইতিহাসে জড়িয়ে আছেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।
সুকুমার সেন, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিত মানুষরা এই দ্বিতীয় মতেরই পক্ষে। ‘বাংলা স্থাননাম’ বইতে সুকুমার সেন লিখছেন, “ঠিক বানান হইবে সভাবাজার, নবকৃষ্ণের ‘রাজসভা’ হইতেই এই নামের উৎপত্তি।” অবশ্য সামান্য পার্থক্য রয়েছে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের বয়ানে। ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে তিনি বলছেন, ১৭৭৫ সালে, নবকৃষ্ণ দেবের মাতৃবিয়োগ ঘটলে তিনি বিরাট জাঁক-জমক করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। সেখানে রাজ-রাজরা-মন্ত্রী-জমিদার-অমাত্যদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোজসভার আয়োজন ছিল রাজকীয়। সেই থেকেই নাকি সুতানুটির ‘পাবনা-বাসনা’ গ্রামটি নাম বদলে হয়ে পড়ে ‘সভাবাজার’। তারপর করমে লোকমুখে ‘শোভাবাজার’। রাজবাড়ির ‘শোভা’র সঙ্গে জড়িয়ে জন্ম নেওয়া লোকনিরুক্তি যাকে বলে।
নবকৃষ্ণ দেবের দুর্গাপুজোয় ক্লাইভ
নবকৃষ্ণের রাজসভাই হোক বা ভোজসভা—শোভাবাজার নামের আড়ালে নবকৃষ্ণ এবং সভার যোগ অস্বীকার করেননি সুকুমার বা হরিসাধন কেউই। এই যুক্তি মেনে নিলে বোঝা যায়, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের প্রতিপত্তি এই অঞ্চলে বেশ ভালোই ছিল। জনমানসে সেই রাজবাড়ির জৌলুসের প্রভাবটাও স্পষ্ট হয় এই নাম থেকে। নবকৃষ্ণ দেবের ব্যাপার-স্যাপারও ছিল এলাহি। নগেন্দ্রনাথ ঘোষ লিখেছেন, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক নবকৃষ্ণই। সাহেব-সুবো, বড়ো মানুষদের জন্য শোভাবাজারের রাজবাড়িতে বাইজি নাচের আসর বসত তখন। আর, জনসাধারণের জন্য হত কবিগান। কবিয়াল হরু ঠাকুর আর নিতাই দাসের পৃষ্ঠপোষকও তো ছিলেন নবকৃষ্ণই। এইসব ছাড়া ছিল হাজারো জমক। ছিল দুর্গাপুজো। ১৭৫৭ সালের দুর্গাপুজোয় নাকি ‘উইলসন’ নামের বিখ্যাত হোটেল থেকে ঢালাও খাদ্য আর পানীয় এসেছিল সাহেব অতিথিদের জন্য।
তবে, নবকৃষ্ণ দেবের দান-ধ্যান ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কথাও ভোলার নয়। জঙ্গল সাফ করে বেহালা থেকে কুলপি পর্যন্ত ৩১ মাইল দীর্ঘ সড়ক বানিয়েছিলেন তিনি। টাকা ঢেলেছিলেন মাদ্রাসা তৈরিতে এবং সেন্ট জোনের গির্জা নির্মাণেও। জনকল্যাণমূলক নানা কাজেও তিনি দান করতেন ভালোই। সব মিলিয়ে এমন মানুষের খ্যাতি তো হবেই।
কালিকৃষ্ণ দেবের বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা
এই বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই ছোটো রাজা কালিকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ি। তিনি ‘রাজবাহাদুর’ খেতাবপ্রাপ্ত। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ বরাবর বাগবাজারের দিকে যেতেই রাস্তার মধ্যিখানে চোখে পড়বে লাল মন্দির। রাস্তা তৈরির সময়েও এই মন্দির ভাঙা হয়নি। এই মন্দির নিয়ে একাধিক কিংবদন্তী। মন্দিরটির তলায় নাকি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। একসময় এই মন্দির নাকি ‘ফেলা কার্তিকের মন্দির’ নামে খ্যাত ছিল। কেউ বলেন, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্বয়ং, কেউ আবার বলেন কালিকৃষ্ণ দেবের নাম।
শোভাবাজার ঘিরে অঢেল গল্প। একসময় এই শোভাবাজারেই জয় মিত্রর বাড়ির উল্টোদিকে আস্তানা গেঁড়েছিল পক্ষির দল। দলপতি ছিলেন বিখ্যাত নিধুবাবু। নেশার ক্ষমতা ও স্টাইল অনুযায়ী পক্ষিরা এক-একটি পাখির নাম পেত। সেই পাখির আচরণও নকল করত তারা। সে এক দিন ছিল বটে। এখন সবই বিগত। প্রতি বছর ২৪ আগস্ট শোভাবাজারের রাজবাড়ির নাটমন্দিরেই আয়োজিত হয় সুতানুটি উত্সব। পরিচালনায় সুতানুটি পরিষদ। বলা হয়, এই ২৪ আগস্ট নাকি কলকাতা শহরের জন্মদিন।
সে যাহোক, শোভাবাজারের নাম নিয়ে ধাঁধাঁরা ঘন হতেই থাকে। কেউ কেউ বলেছেন এই অঞ্চলের আদিনাম ‘সুবাবাজার’। আরবি শব্দ ‘সুবহ্’ মানে রাজপুরুষ। সাহেব-সুবো কথাটির ‘সুবো’ এখান থেকেই আসা। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সাহেব সংসর্গ বেশ ভালোই ছিল। তিনি আরবি-ফার্সি-উর্দু আর ইংরেজিতে চোস্ত ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর ফার্সি শিক্ষক ছিলেন তিনি। গভর্নর ড্রেকের দোভাষীও ছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল দেখার মতো। এমনকি, হিন্দু বাড়ির পুজোয় ইংরেজদের আমন্ত্রণ ও আপ্যায়নের রীতিও নাকি তিনিই চালু করেছিলেন। অসিত দাস বলছেন, নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে সাহেব-সুবোদের এহেন ঘনিষ্ঠতা দেখেই হয়তো অনেকে এই অঞ্চলকে ‘সুবাবাজার’ বলে ডাকতে শুরু করেন। সেই থেকেই কালক্রমে শোভাবাজার নাম জন্মায়।
শোভারাম বসাকের বাজার থেকে সভাবাজার কিংবা সুবাবাজার—‘শোভাবাজার’ নামটির আড়ালে থাকা আসল কারণ খুঁজে বের করা এখন অসম্ভব-প্রায়। তবু পণ্ডিতরা মাথা লাগান, তর্ক করেন, খোঁজ জারি রাখেন। মানুষের স্বভাবই তাই। আর, শহরের স্বভাব বহরে গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়তে থাকা। সেই বাড়াবাড়ির মধ্যিখানে নিজের মেজাজে থেকে যায় কিছু কিছু অঞ্চল। বনেদিয়ানার স্মৃতি বুনে। শোভাবাজারের আসল শোভা ওই মেজাজটাই।
তথ্যসূত্র: ‘বাংলা স্থাননাম’, সুকুমার সেন; ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়; সটীক হুতোম প্যাঁচার নক্শা, অরুণ নাগ সম্পাদিত, নেমপ্লেট, অসিত দাস, প্রতিদিন, রোববার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭।