No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সঙ্গীতের এক জাদুকর

    সঙ্গীতের এক জাদুকর

    Story image

    আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগের ঘটনা। ইংল্যান্ডের একটি দ্বীপে টানা প্রায় পাঁচ দিন ধরে চলছে সঙ্গীত উৎসব। হাজার হাজার গান পাগলের ভিড়ে গিটার নিয়ে গান গেয়ে চলেছেন নানা দেশের কমপক্ষে দু’চারশো গানের শিল্পী। পপ-জ্যাজ-রক-ফোক-কান্ট্রি পাশ্চাত্য গানের যত ধরণ হতে পারে সবই পরিবেশিত হয়ে চলেছে সেই মিউজিক ফেস্টিভ্যালে। এক দুই তিন রাত পেরিয়ে পঞ্চম ও শেষ রাত হাজির। ওই রাত পেরোলেই যবনিকা নামবে। কিন্তু ইতিমধ্যে খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়েছেন প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ। অপেক্ষা করছেন, কখন মঞ্চে আসবেন প্রিয় গায়ক। রাত বারোটা তো বেজে গেছে, একটা, দুটোও বেজে গেল...। ধৈর্য কমছে, বিরক্তির পারদ চড়ছে, শ্রোতারা ক্রমে ক্রমে উত্তেজিত হচ্ছেন। গান বাজনা চলছে ঠিকই কিন্তু শ্রোতাদের গুঞ্জন ধীরে ধীরে হট্টগোলে পরিণত হয়। অবশেষে সমস্ত উত্তেজনার পারদ এক ধাক্কায় নিচে নামিয়ে তিনি মঞ্চে উপস্থিত হলেন চারটের সময়। গিটারে সুর তুললেন- Ah, they'll never, they'll never ever reach the moon/ At least not the one that we're after; ‘পারবে না, কখনও চাঁদ ছুঁতে পারবে না ওরা...।’ বিষাদমাখা সেই সুর ছড়িয়ে গেল ভোর রাতের আধো আলো আধো অন্ধকারে। আর লক্ষ লক্ষ ধৈর্যহারা, প্রবল উত্তেজিত শ্রোতা নিমেষে যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল মায়াবী সুরের নেশায়। দুঃখের সাগরে ডুব দিয়ে যিনি সুরের মুক্তো খুঁজে আনতেন। দূর আকাশে মেঘমুলুকে ভেসে গিয়ে তিনি নিয়ে আসতেন গানের মণি মাণিক্য। তাঁর মতো আর কেউ কী লিখতে পারেন, তাঁর মতো আর কেউ কী গাইতে পারেন-বিষাদগাথা! সেই ‘বিষাদবিধুর গানের সম্রাট’ লিওনার্ড কোহেন সব বিষাদ পেরিয়ে ঘুমের দেশে। সঙ্গীত মহাকাশ কিছুক্ষণের জন্য হলেও অমানিশায় ছেয়ে গিয়েছিল, যেদিন ধূসর নীলাভ নক্ষত্রটি সৌরমণ্ডল থেকে ঝরে পড়েছিল।

    কানাডিয়ান কবি-সুরকার-গায়ক লিওনার্ড কোহেন অবশ্য বরাবরই চেয়েছিলেন লেখক হতে। ছাত্রাবস্থায় তাঁকে যে কোনো গায়কের তুলনায় ঢের বেশি প্রভাবিত করত ডব্লু.বি. ইয়েটস, লোরকার মত কবি ও তাঁদের কবিতা, পড়তে ভাল লাগত ওয়াল্ট হুইটম্যান, হেনরি মিলারের লেখা। বিশেষ করে প্রভাবিত ছিলেন তাঁর শিক্ষক ও বন্ধু আরভিং লেটন-এর দ্বারা। কিশোর বয়সে গিটার বাজানো শিখে তৈরি করেছিলেন লোকসংগীতের দল ‘বাকস্কিন বয়েজ’। স্প্যানিশ লেখক ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সংস্পর্শে এসে কবিতা ভালবেসে ফেলেন। লোরকার সঙ্গে সখ্যের ফলে আরও বিস্তৃত হয় কোহেনের সৃষ্টির পরিধি। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর কোহেন শহর থেকে দূরে গিয়ে বাড়ি কেনেন গ্রিক দ্বীপ হাইড্রায়। সেখানে বসবাসকালে লেখায় মনযোগী হয়ে ওঠেন কোহেন, তাঁর কাব্যচর্চা গতি পায়। প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফ্লাওয়ার্স ফর হিটলার’৷ দুটি উপন্যাস ‘দ্য ফেভারিট গেম’, ‘বিউটিফুল লুসারস’। তাঁর প্রথম অ্যালবাম শ্রোতাদের কাছে হাজির হওয়ার আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘লেট আস কমপ্যার মাইথোলজিস’ ও ‘দ্য স্পাইস বক্স অফ আর্থ’। কিন্তু বাজারে বিকোয়নি তাঁর বই, দাম দেয়নি সমালোচক মহলও। হতাশ কোহেন বেরিয়ে পড়েন নতুন কাজের সন্ধানে৷ কানাডায় ফিরে ঠিক করেন, সব ছেড়েছুড়ে যোগ দেবেন পোশাক নির্মাণ শিল্পে। কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য যিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছেন, মনন যাকে অবিরত তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকবেন কীভাবে?

    ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কে লোকগানের শিল্পী জুডি কলিন্সের সঙ্গে পরিচয়ের পর শুরু হয় গান লেখা। মূলত আর্থিক বেহাল অবস্থা সামাল দিতেই লিখতে শুরু করে ছিলেন। জীবনানন্দের বনলতা সেন কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার মতো কোহেনের ‘সুজান’ গান, কবিতার এক অপূর্ব কথকতা। যেখানে কবিতা হয়ে উঠেছে গান, গান রূপ নিয়েছে কবিতায়। চিরায়ত হয়ে ওঠা এই গান বিশ্বসঙ্গীত জগতে হঠাৎ করে এনে দিয়েছিল এক অন্য মেজাজের স্বাদ। ১৯৬৬ তে জুডি কলিন্স সুজান রেকর্ড করলেন তাঁর অ্যালবাম ‘ইন মাই লাইফ’-এর জন্য। কেবলমাত্র জুডি কলিন্স তো নয়, নেল ডায়মন্ড, নোয়েল হ্যারিসন থেকে শুরু করে জোন বায়াজ; কে না গেয়েছেন--And you want to travel with her, and you want to travel blind/And you know that she will trust you/For you've touched her perfect body with your mind। সুজানের অনুপ্রেরণায় চিত্রপরিচালক মাইকেল ব্যারি আস্ত একটা ছবি ‘দ্য সেক্সন্ড কামিং অফ সুজান’ বানিয়ে ফেলেন।  ১৯৬৭ সালে কলম্বিয়া রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয় ‘সংস অফ লিওনার্ড কোহেন’। এই অ্যালবামে ছিল ‘সিস্টার্স অফ মার্সি’, ‘উইন্টার লেডি’, ‘সো লং মারিয়ান’ এবং অবশ্যই ‘সুজান’-এর মতো ইতিহাস তৈরি করা গান।  সঙ্গে সঙ্গেই সংগীতবিশ্ব এবং আপামর সঙ্গীতপ্রেমীরা পেয়ে গেলেন প্রেম ও বিষণ্ণতার সন্তকে। কোহেনের গানের গভীরতা, কাব্যময়তা, মাদকতা মাখানো সুরেলা কন্ঠ, সহজিয়া ভঙ্গি শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেয় যে তিনি অন্য জাতের, ভিন্ন ঘরানার শিল্পী।

    ১৯৬৯-এ বেরোয় ‘সংস ফ্রম অ্যা রুম’৷ ১৯৭১-এ ভালবাসা, ঘৃণা, হতাশা আর যন্ত্রণার আরেক অনুপম সাঙ্গীতিক দলিল ‘সংস অফ লাভ অ্যান্ড হেট’৷ ১৯৮৮ সালের ‘আই অ্যাম ইওর ম্যান' অ্যালবামেও বেশ চমক দেন লিওনার্ড। ৭৭ বছরের প্রাজ্ঞ বয়সের উপহার ‘ওল্ড আইডিয়াজ'৷ তাঁর কন্ঠ যেন আরো কোমল, আরো ভরাট। নিভৃতে কথা বলছেন৷ যেন দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের সামনে। এই অ্যালবামের দশটি গানেও তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতারই ছবি। ভালবাসার সঙ্গে মিশে গেছে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা, এসেছে মৃত্যুর অনুষঙ্গ। গলার কর্কশতাকে ব্যবহার করতেন মিহিন শব্দের মণিহারীতে। বুকের ভেতর হু হু করে দেওয়া গানের কথা দিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনুরাগী তৈরি করেছিলেন। রোমান্সের অবয়ব তৈরি করেছিলেন সুজান, মারিয়ান, জেনদের গল্পে আবার বিষণ্ণময়তা, ঠাট্টা বিদ্রুপও কম নেই। গানের কথা যেমন কাব্যময়, সাহিত্যধর্মী তেমনই শব্দবন্ধের পরতে পরতে রয়েছে সুর ও ছন্দ।  সেই সুর ছন্দে কিন্তু  প্রতিবাদের স্বর, প্রতিরোধের শ্রুতি। সেই প্রতিবাদ বব ডিলানের মতো ক্ষুব্ধ-কোলাহলময় না হলেও গতানুগতিকতা, প্রাতিষ্ঠানিকতা, ভণ্ডামি, গোড়ামির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপঠাসা উদ্বেগ! বাইবেলকে ঠাট্টা করতে ছাড়েননি কোহেন, তাঁর  ‘হ্যালেলুইয়া’য়।

    অস্থিরমতি কোহেনের জীবনে প্রেম এসেছে বার বার। সম্পর্কে জড়িয়েছেন গায়িকা লরা ব্রানিগন, শ্যারন রবিনসন, অনজনি থমাস এবং জেনিফার ওয়ারনেসের সঙ্গে। সেই নারীদের সান্নিধ্য আর প্রেরণাকে গানের পাথেয় করে তুলেছেন অকৃতদার কবি-গায়ক৷ দুই সন্তানের বাবা হয়েও থেকে গিয়েছেন নিজের কথামতো মুক্ত বিহঙ্গ। ১৯৭৯ সালে রিসেন্ট সংস-এ ওয়ারনেসের বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্টাইল ব্যবহার করেছিলেন কোহেন। ১৯৮৪ সালে ভ্যারিয়াস পজিশন-এ ওয়ারনেসকে কো-ভোক্যাল আর্টিস্টের জায়গায় নিয়ে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ফিউচার’। নিজের গান লেখা, সুর করাকে তিনি বলতেন ‘সেক্রেড মেকানিক্স’। সেখানে কেবল বিস্তার জু়ড়ে বিষাদের স্থান নেই। বরং তিনি কাপলেটে গেথে দিতেন তীক্ষ্ণ রসবোধ। আর স্বাধীন হতে পারার আকাঙ্ক্ষা; প্রেম থেকে, শহুরে শোরগোল থেকে, ধর্ম থেকে, ধর্মহীনতা থেকে... ‘লাইক আ বার্ড অন দ্য ওয়্যার, লাইক আ ড্রাঙ্ক ইন আ মিডনাইট কয়্যার, আই হ্যাভ ট্রায়েড ইন মাই ওয়ে টু বি ফ্রি’... লিখেছিলেন এই চেতনা থেকেই। শরীরের সঙ্গে পবিত্রতার যে যোগ, কথা-সুরে ধরেছিলেন সেই আত্মিকতাকেই। গানেও খুঁজেছেন আধ্যাত্মিকতা, বিষণ্ণতা।

    ১৯৯৩ সালে চরম বিষাদগ্রস্ততার মাঝে দীর্ঘ ছয় বছর কাটান ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট বল্ডির এক আশ্রমে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কিয়োজান জোশু সাসাকির সাহচর্যে। লস অ্যাঞ্জেলসের মাউন্ট বালডি জেন সেন্টারে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন কোহেন। নতুন নাম হয় জিকান। যার অর্থ নিস্তব্ধতা। ২০০১ সালে মৌনতা ভেঙে বেরিয়ে আসেন কোহেন। আবার ফিরে আসেন সংগীতে৷ কনসার্টও করেন ইউরোপসহ বিশ্বের নানা জায়গায়। ২০০৫ সালে শুরু হয় কোহেনের কেরিয়ারের শেষ অধ্যায়। দীর্ঘ দিনের ম্যানেজার কেলি লিঞ্চের প্রতারণার শিকার হয়ে ৫০ লক্ষ ডলার ক্ষতি হয় তাঁর। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্র্যান্ড ট্যুর শেষ হওয়ার পর থেকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি কোহেনকে। তাঁর শেষ অ্যালবাম বেরিয়েছে মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে। ‘ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ নামের সেই অ্যালবামে কবি ফিরে গিয়েছেন বিষাদে গাঁথা তাঁর শিকড়ে। এই ‘ডার্কনেস’, এই ছায়াচ্ছন্নতাই তো ছিল তাঁর লেখার মূলে।

    ধর্ম থেকে রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে যৌনতা মূর্ত হয়ে উঠত তাঁর গানে-কথায়৷ জীবনের নানা আঙ্গিক নিয়ে লিখতেন-গাইতেন অবলীলায়৷ মন ছুঁয়ে যাওয়া অথচ সহজ-সরল মায়াপংক্তি, ‘অ্যান্ড রিমেমবার হোয়েন আই মুভড ইন ইউ, দ্য হোলি ডাভ ওয়াজ মুভিং টু’। তাই প্রশ্ন তো ওঠাটাই স্বাভাবিক যে গীতিকবিতার জন্যই যখন নোবেল তখন লিওনার্ড কোহেন নয় কেন?

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @