No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মুর্শিদাবাদের কড়িয়াল ও গরদের শাড়ি

    মুর্শিদাবাদের কড়িয়াল ও গরদের শাড়ি

    Story image

    মরা যা ‘মুর্শিদাবাদি সিল্ক’ বলে জানি, তার বেশির ভাগই তৈরি হয় মির্জাপুরে। এবছর সেখানকার তৈরি কড়িয়াল গরদ শাড়ি পেয়েছে জিআই তকমা (Geographical Indication)। ভৌগলিক পরিচয় বা জিআই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই রাজ্য-সহ সারা দেশে এমন বহু পণ্য আছে, যেগুলো একটি বিশেষ অঞ্চলেই তৈরি হয়। সেখানকার পণ্য হিসেবে তা সর্বত্র বিখ্যাত বা জনপ্রিয়। জিআই স্বীকৃতি নির্ভর করে তার প্রাচীনত্ব, সেই সংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্য, যাঁরা সেটি বানাচ্ছেন তাঁদের পূর্বসূরিরা প্রথম থেকে তা বানাতেন কি না সে সব বিশ্লেষণের পর। সেই নিরিখেই গরদ ও কড়িয়াল জিআই তকমা পেয়েছে।

    কয়েকশো বছরের পুরোনো এই শিল্পের ইতিবৃত্ত। গরদ হলো একধরনের সিল্ক। গরদ শাড়ি হতেই হবে খাঁটি রেশম সুতোয় বোনা। আমাদের ভারতবর্ষে চার রকমের প্রাকৃতিক সিল্ক মেলে - মালবেরী সিল্ক যা রেশম চাষ করে আহরণ করা যায়;  এছাড়া তিন রকমের বন্য রেশম - তসর, এরি এবং মুগা। গরদ শাড়ির টানা পোড়েন (আড়ে বহরে) দুদিকেই থাকবে মালবেরী সুতো। মোদ্দা কথা গরদ হল বাঙালিদের আপন হাতে তৈরি "পিওর সিল্ক"। সেই বৈদিক যুগ থেকেই হিন্দুদের মধ্যে একদম খাঁটি রেশমবস্ত্র পরে পুজোআর্চার চল। এবার আদিকাল থেকে, ব্রিটিশ আসারও অনেক আগেই রেশম চাষ থেকে শুরু করে সুতো পাকানো, রং করা, কাপড়-ধুতি-উত্তরীয়-রুমাল বোনা ইত্যাদি সমস্তই হত আমাদের অবিভক্ত বঙ্গদেশে; মূলত তৎকালীন মুর্শিদাবাদ-মালদা-বগুড়া-রাজশাহী অঞ্চলে। সে অবশ্য ভারতের আরও কিছু জায়গাতে হত। কিন্তু মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যাপার ছিল ঐ অঞ্চলের রেশম বয়নশিল্পীদের মধ্যে হিন্দু প্রাধান্য আর জলপথে যোগাযোগের সুবিধা। ইসলাম ধর্মে খাঁটী রেশম পরা নিষেধ; কাজেই দেশের অন্য রেশম বয়নকেন্দ্র গুলিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি থাকায় সেখানে পিওর সিল্ক বোনার পরিমাণ ছিল কম, অন্য সুতোর মিশেলে বোনা হতো। ফলে মুর্শিদাবাদের বোনা গরদের চাহিদা ছিল দেশজুড়ে এবং দেশের বাইরেও। 

    চিরাচরিত ধাঁচের গরদ শাড়ি

    পিওর মালবেরী সিল্ক ছাড়াও আজকালকার গরদ শাড়ির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভেলভেট পাড় - সামনের দিকে জেল্লাদার, উল্টোদিকে সামান্য ম্যাট ফিনিশ। এইরকম পাড় বুনতে গেলে ব্যবহার করতে হয় ৪*১ ট্যুইল টেকনিক। ডেনিম জিন্স তৈরি হয় এই নুনন পদ্ধতিতে। পুজোর অনুষঙ্গের কারণেই ঐতিহ্যগতভাবে গরদ হয় সাদা। ছেলেদের সাদা গরদের ধুতি; মেয়েদের জন্য সাদা ঢালা জমির শাড়ি, তাতে টকটকে লাল পাড়। এই টকটকে লাল রঙের পাড় হল মির্জাপুরি "কড়িয়াল" গরদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য - এই কড়িয়াল গরদ অন্যান্যদের থেকে আরও একটু আলাদা, আরও বেশি  স্পেশাল। কড়িয়াল হলো এক ধরনের বয়নপদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পোড়েনে থাকবে তিনটে সুতো, পাড় আর জমির সীমারেখায় তারা শিকলের মত করে সংযুক্ত থাকবে। ফলে জমির সাদা বা আর যে রঙেরই সুতো হোক - তা পাড়ে মিশবে না - এই হল কড়িয়াল বোনার গোড়ার কথা। দক্ষিণভারতে, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুরের দিকেও এই ধরনের বয়নপদ্ধতির খোঁজ পেলাম, সেখানে এর নাম কোরভাই। বংশপরম্পরায় চলে আসা এই কড়িয়াল পদ্ধতির কোন প্রামাণ্য ইতিহাসের হদিশ দিতে পারেন না কেউ। মির্জাপুরে এই শাড়ি প্রস্তুতকারী তাঁতিশিল্পীর সংখ্যাও হাতে গোনা, এই শিল্পের ভবিষ্যৎ  নিয়েও তাঁরা চিন্তিত। 

    জিআই পাওয়ার পর আপনাদের অবস্থার কি কোনও হেরফের হয়েছে? মুর্শিদাবাদ মির্জাপুর হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি-র তরফে সুব্রত গুঁচি বলেন, ‘‘কড়িয়াল শাড়ির শিল্পী বড়ো জোর ২ শতাংশ। মজুরি কম, সময় বেশি। তবে মুর্শিদাবাদে গরদ বলতে মির্জাপুরের শিল্পীদের বোঝায়। সকলেই প্রায় গরদ তৈরির সঙ্গে জড়িত। স্বীকৃতি পেলে প্রচার বাড়বে, শিল্পীদের কদর, সুনাম বাড়বে। স্বভাবতই গরদ শিল্পীরা লাভবান হবে। এর ফলে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষজন জানতে পারবেন মুর্শিদাবাদে গরদের কারিগর কারা।”

    মুর্শিদাবাদে মির্জাপুর মূলত গরদ সিল্কের জন্য খ্যাত। আগে গরদের শাড়ি দখল করত সীতাহরণ, জটায়ু বধ, শকুন্তলা। এখন পুরাণ সরিয়ে তাতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

    প্রতি বছর রাজ্য সরকার আয়োজিত তাঁতমেলাতেও অংশ নেয় মির্জাপুরের হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি

    মির্জাপুরে হাতে গোনা কড়িয়াল শিল্পীদের বাড়িতে একাধিক তাঁত রয়েছে। সবেতেই কড়িয়াল ও জাকার্ড। গরদের শাড়িতে হাতের কাজ যতটা ভাল ফুটিয়ে তোলা যায় অন্য শাড়িতে তা যায় না। কড়িয়ালে সাদা শরীরের দুই দিকে ৫ থেকে ৭ ইঞ্চির পাড়। সুন্দর দেখতে লাগে। ‘‘কড়িয়াল গরদের মধ্যে একটি ক্লাসিক প্রোডাক্ট। কড়িয়াল শাড়ি তৈরির জন্য যে সময় লাগে বাস্তবে গরদের অন্য শাড়ি সেই সময়ে ২ থেকে ৩টি তৈরি করা যায়। সেই কারণেই তাঁতিরা কড়িয়াল শাড়ি তৈরির দিকে যায় না। এই শাড়ি তৈরি করতে হয় সম্পূর্ণরূপে হাতে। সেই শাড়ির চাহিদা নেই তা নয়। কিন্তু দাম বেশি, তুলনায় সময়ের কারণে মজুরি কম। তাই শুধু কড়িয়ালের উপর জিআই ট্যাগিংয়ে সেভাবে কোনও সুবিধে হবে না তাঁত শিল্পীদের। তবে সমস্ত গরদ যদি জিআই তকমা পেয়ে থাকে তবে মুর্শিদাবাদের গরদ যথেষ্ট লাভবান হবে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যে।” বলেন সুব্রতবাবু।

    মুর্শিদাবাদে মির্জাপুর মূলত গরদ সিল্কের জন্য খ্যাত। আগে গরদের শাড়ি দখল করত সীতাহরণ, জটায়ু বধ, শকুন্তলা। এখন পুরাণ সরিয়ে তাতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সাদা সিল্কের সুতোকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তা দিয়েই তৈরি হচ্ছে গরদের রঙিন জাকার্ড শাড়ি। কোনওটা সিঙ্গল জাকার্ড, কোনওটা ডাবল। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে থার্ড জাকার্ডের তাঁতের ছোঁয়া। একটায় পায়ের দিক, দ্বিতীয়টা বডি এবং তৃতীয়টা মিনা। এই ত্রিমুখী নকশার অভিনবত্বে তা নজরে ধরেছে আধুনিকাদেরও। পুরোনোকে সঙ্গে নিয়েই আজ সাজ-এ ধরা পড়ছে পরিবর্তন।

    জাকার্ডের কারিগর হাতে গোণা, তাই চাহিদার সঙ্গে জোগানের তাল মেলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁত শিল্পীদের। মির্জাপুরের ব্যবসায়ীদের কথায় দু’বছর আগেও জামদানি, কাঁথা স্টিচ, আরি স্টিচ, নিমজরির বাজার ছিল মির্জাপুরে। এখন  নাকি সেই সব শাড়ির চাহিদা নেই। রঙিন জাকার্ড মির্জাপুরের শিল্পীরাই তৈরি করেন। দামে বেশি হলেও মেয়েদের চোখ টানছে। সিল্কের শাড়িতে এ বার নতুনত্ব এনেছে মির্জাপুর। এ বার পুজোর বাজার অনেকটাই দখল করেছিল জাকার্ড ব্রোকেড। পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত দামের এই সিল্কের শাড়ির চাহিদা বিপুল। এ হল জাকার্ড তাঁতে বোনা রঙিন গরদ সিল্কের শাড়ি। সীতাহরণ, জটায়ু বধ, শকুন্তলাদের দৃশ্য পাল্টে এখন নকশায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। সাদা সিল্কের সুতোকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তার সঙ্গে থাকছে মিনার কাজ। বাজারে এই শাড়ি চলছে ‘‘জাকার্ড ব্রোকেড অল মিনা’’ নামে। 

     

    তথ্যঋণ:
    মির্জাপুর হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি
    শাড়ি চেনার রাফখাতা পর্ব ৩ ঃ গরদ শাড়ি, Pubali Datta (https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=22893)
    আনন্দবাজার পত্রিকা (ফুলিয়া থেকে বিষ্ণুপুর, সর্বত্রই শাড়িতে নতুনত্ব)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @