‘ইতালি’ হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা পেল জার্মানির মিউনিখ

মিউনিখের ল্যান্ডমার্ক, বিএমডাব্লু-র সদর দপ্তর
মিউনিখের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে স্টার্নবার্গ জেলা। একই নামের শহরে খ্যাতনামা এবং ধনী মানুষেরা বাস করেন হ্রদের ধার ঘেঁষে। হ্রদের নামটিও এক – স্টার্নবার্গ। এই জেলারই স্টকডর্ফে ওয়েবাস্টো কোম্পানির সদর দপ্তর। কোম্পানির কর্মচারী এক চিনা মহিলা কাজেরই সূত্রে স্টকডর্ফ এসেছিলেন। জানুয়ারির মাঝামাঝি যখন সাংহাই থেকে মিউনিখ রওনা দেন, তখন জানতেন না, তাঁর কারণে পরের দু’মাসে ইউরোপের সবথেকে বড়ো অর্থনীতি ধসে যেতে চলেছে। ইতালির দাবি অনুযায়ী, তিনি ইউরোপে পা রাখার ফলে সেই দেশেও চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।
সেই চিনা মহিলা ফিরে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর, ২৮ জানুয়ারি, স্টকডর্ফে ওয়েবাস্টো কোম্পানির দপ্তরে বিপদঘণ্টি বেজে ওঠে। জানা যায়, তিনি জার্মান সহকর্মীদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বাবা-মা দু’জনেই ইউহানের বাসিন্দা, যা চিনে করোনা সংক্রমণের মূল কেন্দ্র। তৎক্ষণাৎ দু’সপ্তাহের জন্য সদর দপ্তর বন্ধ করে দেয় ওয়েবাস্টো। দপ্তরটিকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়। করোনায় আক্রান্ত কর্মীরা সেরে ওঠেন। দু’সপ্তাহের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ারও কোনো খবর মেলে না। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ সবাই ধরে নেয়, করোনার বিস্তার রোধ করা গিয়েছে।
এই স্বস্তি ছিল সাময়িক। ফেব্রুয়ারির শেষে কার্নিভাল ব্রেক শুরু হয়, স্কুলগুলোয় ছুটি পড়ে। এমন সময়ে করোনা আবার মাথাচাড়া দিতে থাকে। ইতিমধ্যে জার্মানির ১৫ জন ওয়েবাস্টো কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, সেরেও উঠেছেন। ইতালিতে ৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, যার জন্য রোমে বেড়াতে আসা চিনা পর্যটকদের দায়ী করছে সেখানকার মানুষজন। উত্তর ইতালির রাজ্যগুলির কোনো হেলদোল নেই, সেখানকার বাসিন্দারা ঘনিয়ে আসা বিপর্যয় আঁচ করতে পারেনি তখনও।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইতালিতে যেন জৈব গণহত্যা শুরু হল। ঝড়ের গতিতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। খোলা সীমান্ত, মুক্ত বাণিজ্য, শীতের কার্নিভাল – এত কিছু নিয়ে ইউরোপ সত্যিই অসহায়। স্বাধীনতা যখন তার মূল্য দাবি করে, সেটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ।
লক ডাউনের প্রথম দিনে বাভারিয়া
এরকম সময়ে আমাকে প্রত্যেক সপ্তাহে প্যারিস, আমস্টারডাম এবং লন্ডন যেতে হত। তখনই দেখতাম, মানুষ সতর্ক হয়ে উঠছে। সকালের ব্যস্ত সময়ে এয়ারপোর্টের লম্বা লাইন ক্রমশ কমে এসেছে। দূর প্রাচ্য থেকে যাত্রী নিয়ে হিথ্রোর দ্বিতীয় টার্মিনালে প্রতিদিন সকালে যে ৬টি এ৩৮০ ঢুকত, তা আর দেখা গেল না। সন্ধেবেলাও লাউঞ্জের কোণের সিটগুলো ফাঁকাই রইল। সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু, এটা কেউ জানত না যে একমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতায় রাশ টেনেই করোনার গতি রোধ করা যায়। মিডিয়া তখনও চিনের লকডাউনকে ‘স্বৈরাচারী পদক্ষেপ’ মনে করত।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিরাপত্তা সবার আগে, তাই স্কি ব্রেকে ভিড় থেকে দূরে থাকাই ভালো। রিএফেনসবার্গে চললাম আমরা। জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার সীমান্তে এই জায়গাটার নামডাক সেরকম নেই। এটা হয়তো চলতি বছরে আমার সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটা।
করোনা ভাইরাস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে। বাভারিয়ার সেই চিনা কর্মীকেই মনে করা হয় ইউরোপে করোনার বাহক। স্কি ব্রেক, মিলান ফ্যাশন উইক, কার্নিভালে দে ভেনেজিয়া – এই উৎসবগুলো ইতালির লম্বার্ডি, ভেনেতো-র মতো রাজ্য থেকে ভিড় টেনে আনে। এ্রর থেকেই শুরু হল বিপর্যয়। চিনের নববর্ষের মতো ইউরোপে ফেব্রুয়ারি উৎসবের মাস। মিলানকে ঘিরে যে ফ্যাশন ক্লাস্টার চলে, সেখানে ইউহান থেকে সরাসরি ফ্লাইট এবং অভিবাসীরা আসতে থাকে।এভাবেই সক্রিয় থাকে আর্মানি, গুচ্চি এবং প্রাদার সাপ্লাই চেন।
কবলেনজ – রাইন এবং মোসেল নদীর সংগম
ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বড়ো মাত্রায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। মানুষ অসুস্থ হয়ে স্কুল এবং অফিসে যাওয়া বন্ধ করে। দক্ষিণ তিরোলের স্কি-খেলোয়াড়দের বলা হয় হোম কোয়ারেন্টিনে যেতে। ৪ মার্চের ফ্লাইটে লন্ডন থেকে ফেরার সময় সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, এখন কয়েক সপ্তাহ ঘোরাঘুরি বন্ধ করতে হবে। ৮ মার্চ উত্তর ইতালি লকডাউনে চলে যায়। পরের এক দিনে ১০০ লোকের মৃত্যু হলে গোটা ইতালি লক ডাউনের আওতায় গিয়ে পড়ে। ১১ মার্চ কোভিড-১৯’কে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করা হল। স্টকডর্ফে সংক্রমণের দেড় মাসের মধ্যে যেন সুনামি আছড়ে পড়ল ইউরোপে।
এখন সম্পূর্ণ লক ডাউন। একটা করুণ ভিডিওতে দেখছি, ইতালির সৈনিকরা কফিন বয়ে নিয়ে কবর দেওয়ার জায়গা খুঁজছে। আমার বাড়ি থেকে ১০ মিনিট ড্রাইফ করে স্টকডর্ফ পৌঁছনো যায়। সেটাও ইতালি হয়ে উঠতে পারত। ১৯৭২ সালের মিউনিখ হত্যাকাণ্ডের থেকেও হাজার গুণ ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারত এখানে। স্টকডোর্ফ সম্ভবত আক্রমণটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারল। যদিও, এখন জার্মানিতে করোনা ভালোভাবেই থাবা বসিয়েছে।