No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মুজতবা আলীই প্রথম বলেন, উর্দু চাপালে পাকিস্থান ভেঙে যাবে

    মুজতবা আলীই প্রথম বলেন, উর্দু চাপালে পাকিস্থান ভেঙে যাবে

    Story image

    উর্দু চাপিয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে, এ কথা ভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের মাথায় ছিল না, ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর, যিনি পাকিস্তানের জন্মের ১০৫ দিন পরে এই সতর্কবাণী করেন। আলী সাহেব ৩০ নভেম্বর ১৯৪৭ সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদে বলেন ‘যদি উর্দুকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে এর ভবিষ্যৎ কখনই ভালো হবে না। বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে একদিন আমাদের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।’ এই বক্তব্যে তিনি সেই সময়কার রক্ষণশীল কিছু মানুষের রোষে পড়েন এবং তাঁকে নানাভাবে অপমানিত করার চেষ্টা করে, তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়। কিন্তু আলী সাহেব টানা তিন ঘণ্টা ধরে পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তিজালে তাদের মোকাবিলা করেন ও তাঁর বক্তব্যে অটল থাকেন। আবার সাবধান করেন যে, 'পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয়, তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে। ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।' সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রতিপন্ন হয়। তিনি বলেছিলেন আরবদের ইরান ও তুর্কি বিজয়ের পর যখন তাদের ওপর আরবি ভাষা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ‘মোগলরাও আমাদের ওপর ফারসি ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। পারেনি।’

    অন্যদিকে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলন ও গণমত সংগঠিত হয়, তা পাকিস্তানের ভিতরে থেকেই পেকে উঠছিল, যদিও ১৭ নভেম্বর ১৯৪৭ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে ঘোষণা দেওয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকপত্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয় (মুখ্যমন্ত্রী পদ তখনও সৃষ্টি হয়নি, প্রধানমন্ত্রীই বলা হত)। তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু?’ নামে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয়, যখন সরকারি কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকত। সেখানে দাবি করা হয় বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা ও সরকারী দপ্তরগুলিতে ব্যবহৃত ভাষা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি- বাংলা ও উর্দু। বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাবিভাগের প্রথম ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ জনই এ ভাষা শিক্ষা করবেন। আর সেখানে উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হবেন, তারাই শুধু উর্দু ভাষা শিক্ষা করবেন। এবং তা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ থেকে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া হবে।

    পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসাবে অভিহিত করে। পূর্ব-পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে "পাকিস্তানীকরণ"-এর চক্রান্ত করে। তমদ্দুন মজলিশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ পৃথক রাষ্ট্রের দিকে ক্রমশ ধাবিত হতে পারে, সেই সময় এঁদের কল্পনাতেও ছিল না। সে দূরদৃষ্টি ছিল মুজতবা আলীর মত বহুভাষাবিদের।

    আলী সাহেবের ভাষণের দিন দশেকের মধ্যেই ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। তার পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাকিস্তান গণপরিষদে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর প্রস্তাবকে স্বাগত জানান পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সাংসদ প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য, এদের সমর্থনে দাঁড়াননি যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল। তখন তো তিনি পাকিস্তান গণ পরিষদের অস্থায়ী অধ্যক্ষ।  তিনি অবশ্য ভাষা আন্দোলনে কখনো পরোক্ষ সমর্থনও করেননি।

    সিলেটের সেই সভার পরে মুজতবা আলী কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় লিখিত বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেন। এক বছর বাদে বগুড়ায় এক সাহিত্য সভায় আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে আরো জোরে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে কথা বলেন। বগুড়া আজিজুল হক কলেজের উপস্থিত শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁর জ্ঞানের পরিধি এবং বক্তব্যে আকৃষ্ট হন। সেদিনটি ছিল ১২ ডিসেম্বর ১৯৪৮।

    আলী সাহেব কলকাতার বিশাল সাহিত্য জগৎ ছেড়ে ক্ষুদ্র বগুড়া জেলা শহরে বসবাসে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে বগুড়ার মানুষ তাঁদের আপনজন মনে করতেন। কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলে কলকাতা গিয়ে বহু অনুনয় করে তাঁকে বগুড়ায় কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিতে সম্মত করান। তিনি ১৯৪৯ সালের শুরুতে কলেজটিতে যোগদান করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে বগুড়া তখন চরম উত্তেজনাময় ছিল। স্থানীয় রক্ষণশীল চক্র তাঁর অধ্যক্ষ পদে যোগদান সুনজরে দেখেনি, তাঁরা শুরু থেকেই আলী সাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। এর কিছুদিন পরই প্রকাশিত কলেজের বার্ষিক পত্রিকায় কলেজের কিছু ছাত্র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখে। যদিও মুজতবা আলী দায়িত্ব গ্রহণের অনেক আগেই ঐ পত্রিকায় ঐ লেখাগুলি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তিনিই 'পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে' প্রবন্ধ রচনার জন্য শিক্ষার্থীদের 'প্ররোচিত' করেন। জেলা সমাহর্তা পত্রিকাটিতে অধ্যক্ষের বাণী (অত্যন্ত উঁচুমানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ হলেও) প্রকাশের জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ও সব কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়। অধ্যক্ষের কোনো বাসভবন ছিল না। তাই আলী সাহেব থাকতেন তাঁর অকৃতদার মেজভাই সৈয়দ মর্তুজা আলীর(জেলা প্রশাসক) বাসায়। ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু মুজতবা আলীকে হয়রানি করেনি, তাঁর ভাইকেও এর সঙ্গে জড়িত করতে চেষ্টা করে। এর ফলে গ্রেফতার এড়াতে মুজতবা আলীকে কলকাতায় পালিয়ে যেতে হয়েছিল। মাত্র ছয় মাসের মাথায় বগুড়া অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

    ভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে এক সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের আপসহীন ভাষা আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অবশেষে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এই স্বীকৃতির পরই মুজতবার সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা ঢাকায় প্রথমে আল ইসলাহ ম্যাগাজিনে এবং পরবর্তী সময়ে 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটি ২০০২ সালে একুশে পাবলিকেশন্স নতুন করে প্রকাশ করে। এ বইটিই প্রমাণ করে, মুজতবা আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের এক অন্যতম স্থপতি।

    আজীবন মুজতবা আলী অসত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন ও বিদ্রোহী জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু মাথানত করেননি। একবার (১৯২১) সিলেট সরকারি স্কুলের তাঁর কিছু হিন্দু সহপাঠী স্থানীয় ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনার জেমস ডসনের বাগান থেকে সরস্বতী পূজার জন্য কিছু ফুল চুরি করেছিল। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের ডেকে পাঠিয়ে তাদের বেত মারা হয়। তখন অসহযোগ এবং খেলাফত আন্দোলন চলছিল। বেত মারার ঘটনাটি আগুনে কেরোসিন ঢালার মতো কাজ করে। সেদিনই স্কুল বয়কটের নেতৃত্ব দেন নবম শ্রেণীর ফার্স্ট বয় মুজতবা আলী। ব্রিটিশ সরকার পরিস্থিতি শান্ত করতে অভিভাবকদের ওপর, বিশেষ করে সিলেটের জেলা রেজিস্ট্রার মুজতবার পিতা সৈয়দ সিকান্দার আলীর ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু মুজতবা ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত স্কুলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তার কিছুদিন আগে স্থানীয় মুরারীচাঁদ কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক ভাষণ 'আকাঙ্ক্ষা' শুনে তিনি কবিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কবিগুরু তাঁকে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। মুজতবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দমনমূলক কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি, রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে শান্তিনিকেতনে পাড়ি দিলেন।

    বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক হওয়ার পর কিছুদিন আলীগড় কলেজেও পড়লেন। তারপর কাবুল চলে গেলেন। সেখানে থেকেই বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য জার্মান সরকারের বৃত্তি লাভের আবেদন করেন এবং বৃত্তি পেয়ে যান। জার্মান ভাষা শেখেন। কিন্তু মুজতবা কোনো ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি। জীবনের অধিকাংশ সময় বিদেশে কেটেছে, কিন্তু তাঁর মনটা ছিল বাংলাদেশে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং জীবনের বাকি দিনগুলো সেখানেই কাটান ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @