সমরেশ তোমাদের ‘মৃত্যুফাঁদ’ আঁকা শেখাচ্ছে

যে সময়ে রবীন্দ্রভারতীতে পড়তে গেলাম সেই আশির দশক পর্যন্ত শিল্পকলার এই আঁতুড়ঘরটি প্রকৃত অর্থে অনাদরেই ছিল। কারও কাছে চৌরঙ্গীপাড়ার ট্রেনিং না হলে ঠিক যেমন শিল্পী হওয়া যায় না আবার কারও মতে রাবীন্দ্রিক হাওয়া গায়ে লাগাতে গেলে বোলপুরের রেলগাড়ি ধরাটাই সব থেকে বড় কাজ। আসলে তাঁদের মোদ্দা কথাটা ছিল ‘যার নাই কোনও গতি সেই যায় রবীন্দ্রভারতী’। সেই ধারণাটা ভেঙে দিয়েছিলেন মাস্টারমশাই-রাই। কারণ চোখের সামনে দেখলাম তাঁদের কেউ কলাভবনে নন্দলাল বসুর ছাত্র তো কারোর আবার চৌরঙ্গীর আর্ট কলেজটাই শিল্প শিক্ষার গোটা জীবনের তীর্থস্থান। তাহলে কেন এই জাতীয় মন্তব্য আর গুজবের পাঁচকান ভেবে পেতাম না তখন। যাই হোক যেসব গুণীজনের আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেলাম তাঁরা হলেন শানু লাহিড়ী, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতিম দেব, মানিক তালুকদার, রবীন মণ্ডল, সমরেশ চৌধুরী, শোভন সোম, পিনাকী বড়ুয়া, হরেকৃষ্ণ বাগ, লক্ষ্মীনারায়ণ পাচোরী, প্রকাশ দাস, অনিমেশ নন্দী, অজিত চক্রবর্তী প্রমুখ। বলতে গেলে ‘নাই গতির দেশেই’ আমাদের গতির চর্চা শুরু হল। দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির দালানের চার পাশে। তখন কেউ মাটি মাখামাখি করতে শুরু করলাম তো কেউ লাগলাম গাছ লতা পাতা আঁকতে যাকে বলে ফোলিয়েজ স্টাডি।
এরকম চলতে চলতেই একদিন শুরু হয়ে গেল পারস্পেক্টিভের ক্লাস। মানে পরিপ্রেক্ষিত শিক্ষা। এক অসাধারণ আনন্দ তখন আমাদের মনে। অঙ্কের নিয়মে কাছের জিনিস বড় হয়ে যায় আর দূরের জিনিস আপনা থেকেই ছোট হতে থাকে। তা ছাড়া সব থেকে যেটা মনে দাগ কাটার মতো ব্যাপার তা হল দিগন্ত রেখায় বিলয় বিন্দুতে দুটো তির্যক রেখা রেল লাইনের মতো মিললেই যে রাস্তা তৈরি হয় সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকে যাওয়া যায় যেন ছবির ভেতরে। আবার মনে হয় ছবির ভিতরে ঢুকে যেন ঘোরা ফেরা করতেও অসুবিধে হয় না। বুঝলাম এ সবের মূল মন্ত্র হল ভ্যানিসিং পয়েন্ট বা বিলয় বিন্দু। এই ক্লাসটা নিচ্ছেন তখন সমরেশ চৌধুরী। তিনিই আবার ভাস্কর্যের মাটি মাখামাখি শেখাতেন। তাছাড়া লাইফ ড্রইং-য়ের ক্লাসে এসে যে ভাবে ধরিয়ে দিতেন অ্যানাটমির সব ধরতাই তাতে সকলের তাক লেগে যেত। যাই হোক ওনার কাছে তখন বিলয় বিন্দুর ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। মনের আনন্দে ছবি আঁকছি। রেল লাইন, রাস্তা, গলি, রানওয়ে সব মিলিয়ে ছবির ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষেত্র গভীরতার কৌশল রপ্ত করছি আমরা।
মাঝে মধ্যে অন্যান্য মাস্টারমশাইরা হেঁটে চলে এদিক ওদিক যাওয়ার সময় দুদণ্ড দাঁড়িয়ে দেখতেনও যে আমরা কে কী করছি। এরকমি একদিন শোভন সোম মশাই যাচ্ছিলেন ঠাকুর দালানের ওদিক দিয়ে। সহসাই ঘুরে এলেন আমাদের দিকে। এসে আমাদের খাতাপত্রের দিকে তাকাতে তাকাতেই জিজ্ঞাসা করলেন ‘কীসের ক্লাস চলছে ?’ আমরা একযোগে বলে উঠলাম ‘স্যার বিলয় বিন্দু।’ স্যার অট্টহাসি হেসে বলে উঠলেন ‘ও বুঝেছি বুঝেছি সমরেশ তোমাদের ‘মৃত্যুফাঁদ’ আঁকা শেখাচ্ছে এখন। ‘বলেই আবার স্যারের প্রাণখোলা হাসি। সবার মনে মনে প্রশ্ন উঠল বিলয় বিন্দু মানে মৃত্যুফাঁদ কেন রে ভাই! সমরেশবাবুকে বললাম ‘জানেন স্যার আজ শোভন স্যার বললেন বিলয় বিন্দু মানে মৃত্যুফাঁদ। এটার মানে কী স্যার?’ স্যার ভ্রু কুঁচকে বললেন ‘সে আবার কী? তা সেটা ওনাকেই জিজ্ঞাসা কর।’
তো এরকম একদিন স্পেশাল ক্লাসে শোভনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘আচ্ছা স্যার বিলয় বিন্দু মানে মৃত্যুফাঁদ কেন?’ প্রশ্নটা শুনে আমার দিকে স্যার অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন ‘ওটা আমার একটা গল্পের নাম।’ আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম ‘গল্পটা কীরকম স্যার?’ স্যার এবার বললেন ‘গল্পটা আসলে একটা ক্রাইম স্টোরি।’ কথাটা শুনেই মনটা আমাদের চঞ্চল হয়ে উঠল। বললাম ‘বিলয় বিন্দুতে ক্রাইম স্টোরি সেটা কীরকম স্যার?’ এবার স্যার আমাদের শোনাতে লাগলেন গল্পটা।
কলকাতার কোনও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন ভদ্রলোকের সম্ভবত মধ্য কলকাতায় একটি পৈতৃক বাড়ি ছিল। কিন্তু কালের নিয়মে বাড়িটির অবস্থা আর ভালো নেই তাই সেটিকে এবার প্রোমোটারের হাতে দেবেন বলে ঠিক করেছেন ভদ্রলোক। সবই ঠিক ছিল কিন্তু সেই জীর্ণ বাড়ির এককোণে থাকেন কালশশী বাবু নামের যে ভাড়াটে তিনি ওখান থেকে কিছুতেই উঠতে রাজি নন। টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়েও কোনও লাভ হয়নি, গুণ্ডার ভয় দেখিয়েও নয়। এরকম অবস্থায় একদিন বাড়ির মালিক নিজে ঠিক করলেন তথাকথিত কালশশী বাবুর সাথে নিজেই দেখা করবেন। সেই হিসেবে হাজির হলেন পৈতৃক ভিটের বারান্দার শেষ মাথায়। দরজায় কড়া নাড়তেই বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। ঘরের বাতি ইলেকট্রিকের বিল না দেওয়ার কারণে কবেই কাটা পড়েছে। তাই তার ছেঁড়া কলিংবেলটাও কাজ করে নি। যাই হোক ভদ্রলোক আসুন বসুন করে ঘরের মালিককে আপ্যায়ন করলেন। মালিকের সরাসরি প্রশ্ন ‘কবে উঠছেন বলুন তো?’ কালশশীর উত্তর - ‘আর কদিন বাঁচব! নিজের মতো ছবি আঁকি আমাকে বাদ দিয়েই না হয় ভাবুন। আমি কিন্তু উঠব না।’ মালিক অবাক হয়ে বললেন ‘ভারী নাছোড়বান্দা লোক তো মশাই আপনি। তা বেশ আপনি কী আঁকেন-টাকেন শুনি?’ কালশশী বাবু বললেন ‘আমার ছবি আপনি ঠিক বুঝবেন না। আমার ছবি দেখতে গেলে বিলয় বিন্দু জ্ঞান থাকা দরকার।’ মালিক বললেন ‘তা দেখি আপনার কেমন ছবি?’ এবার কালোশশী বাবু একটা ক্যানভাসের ওপর থেকে একটা ছেঁড়া ন্যাতা সরিয়ে বললেন ‘দেখুন ছবিটা। তবে এই যে রাস্তাটা আছে এটা ধরে ঢুকবেন আবার এটা ধরেই বেরোবেন। তবেই হবে।’ সেই মতো ভদ্রলোক তির্যক রেখার রাস্তা ধরে ছবিটির ভেতরে ঢুকে গেলেন। দেখলেন তিনি টাউন হলে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গান করছেন আর দীনেন্দ্রনাথ এস্রাজ বাজাচ্ছেন। ভদ্রলোক আপ্লুত হয়ে রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নিলেন। তারপর আবার বিলয়বিন্দুর পথ ধরে বেরিয়ে এলেন। হাতে তখন তাঁর টাটকা টাটকা রবীন্দ্রনাথের সই।
এই রকম চলতে লাগল। দিনের পর দিন। কালশশী বাবুকে তাড়ানোর কথা প্রায় ভুলেই গেলেন মালিক। তিনি রোজই আসেন, বিলয় বিন্দুর পথ ধরে ছবিতে ঢোকেন আর কখনোও জাহাঙ্গীরের মুদ্রা, কখনও হরপ্পার পটারি বা মূর্তি তুলে আনেন ছবির ভেতর থেকে। কিন্তু কালশশীর ধারণা আরও তীব্র হয় যে এবার যে-কোনো দিন মালিক তাঁকে উচ্ছেদ করবেই করবে। এরকম একদিন কালশশী নিজে থেকেই বললেন ‘কাল আপনাকে একটা ছবি দেখাব আসবেন কিন্তু।’ ভদ্রলোক বললেন ‘অবশ্যই’। কথামতো ভদ্রলোক এসেও গেলেন। এবার আর তাঁর তর সয় না। বললেন ‘কই দেখান’। কালশশী বাবু বললেন ‘দাঁড়ান আরেকবার একটু বিলয় বিন্দুতে ঢোকার ছকটা ঝালিয়ে নিন।’ ভদ্রলোক বললেন ‘আরে মশাই আমার প্র্যাক্টিস আছে।’ কালশশী এবার ক্যানভাস থেকে ন্যাতা তুলে বললেন ‘বেশ তবে ঢুকুন এটার ভেতর তবে তির্যক রেখা দুটো মনে রাখবেন বেরোনোর সময়।’ টাইম মেশিনের মতো ছবিতে ঢুকে গেলেন ভদ্রলোক।
ছবিতে প্রবেশ করে ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বুঝলেন তিনি একটা জাহাজে প্রবেশ করেছেন। বসে আছেন একটা কেবিনে। সবকিছু ততক্ষণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিলয় বিন্দুতে মেশা রাস্তা ধরেই জাহাজের কেবিনে প্রবেশ। ভদ্রলোকের পাশে এক বৃদ্ধ। এবার আলাপ করে জানা গেল বৃদ্ধের নাম সিন্ধুমাধব সেন। নামটা শুনে চমকে গেলেন ছবিতে প্রবেশ করা মানুষটি। কারণ এই বৃদ্ধ হলেন টাইটানিক জাহাজের একমাত্র বাঙালি যাত্রী। এর পরেই প্রবল ঝাঁকুনি। দেখতে দেখতে জাহাজ তোলপাড়। শোভনবাবু এবার থামলেন। বললেন কালশশী আতঙ্কে ওঁকে টাইটানিকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এরপর?
প্রবল হট্টগোলে ভদ্রলোক বেড়িয়ে গেলেন কেবিনে। চতুর্দিকে জল ঢুকছে। এবার জাহাজ যখন মাঝখান থেকে ভেঙে পরার উপক্রম তখন ভদ্রলোক চাইলেন ছবি থেকে বেরিয়ে যেতে। এবার দেখলেন ঠিক কোন কেবিনটা থেকে তিনি বেরিয়েছেন তা আর তিনি মনে করতে পারলেন না।
সেদিন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। ভদ্রলোক বাড়ি ফিরছেন না দেখে উনার স্ত্রী সরাসরি হাজির হলেন সেই বাড়িতে। দেখলেন তাঁর স্বামীর গাড়িটা বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছে। গিয়ে ঢুকলেন কালশশীর ঘরে। জিজ্ঞাসা করলেন। কালশশীর উত্তর – ‘উনি এসেছিলেন, চলেও গেছেন।’
গল্প শেষ করে শোভন বাবু বললেন ‘তাই বলছিলাম বিলয় বিন্দু মানে মৃত্যুফাঁদ।’
শোভনবাবুর গল্পের সব চরিত্রদের নাম আমার আর মনে নেই। নামগুলো দিলাম আমি, আর সাজিয়ে দিলাম কেবল গল্পটার নির্যাস।
(অলংকরণ - পার্থ দাশগুপ্ত)