No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মৃণাল সেনের বোন রেবা এবং জসীমউদ্দীদের গোপন কবিতা  

    মৃণাল সেনের বোন রেবা এবং জসীমউদ্দীদের গোপন কবিতা  

    Story image

    আজ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় বঙ্গদর্শনে রইল চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন ও তাঁর বোন রেবা সেনের সম্পর্কের এক আখ্যান। এই সম্পর্কের মাঝে সাক্ষী ছিলেন কবি জসীমউদ্দিন। 

    বাংলা সিনেমায় এক স্বতন্ত্র আঙ্গিক তৈরি করেছিলেন মৃণাল সেন। শুধু বাংলা সিনেমাই বা বলব কেন, তাঁর ছবিগুলি সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, ওষুধ বিক্রির কাজও করতে হয় তাঁকে। চলচ্চিত্রের শব্দ কলাকুশলীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাত-ভোর’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। তারপর ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘ভুবন সোম’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’ – একের পর এক ছবি। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া এবং তেলুগু ভাষাতেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

    কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক মৃণাল সেনের জন্ম হয়েছিল ফরিদপুরে।  বড়ো পরিবারে তাঁরা ছিলেন সাত ভাই ও পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে মৃণাল ষষ্ঠ আর সবথেকে ছোটো বোনের নাম রেবা। বাড়ির লোকেরা তো বটেই, প্রতিবেশীরাও রেবাকে খুব ভালোবাসতেন।

    তাঁদের বাড়িতে এক সুন্দর পুকুর ছিল। ঘাটের সিঁড়িগুলো বাঁশের। পরিবারের সবাই ঘাটে যেতে ভালোবাসতেন। সিঁড়িতে বসে পা ঝুলিয়ে দিতেন জলের ওপর। রেবাও জলের ওপর পা নাচাত। পুকুরের একেবারে সামনের ধাপটি ছিল তার পছন্দ। 

    এক ছুটির দুপুরে বাড়ির সবাই ভাত খাচ্ছিলেন। রেবার খাওয়া আগে হয়ে যাওয়ায় সে পুকুরঘাটে চলে যায়। বাকিদের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, তা কেউ জানে না। পুকুরের কাছে আর কেউ ছিল না তখন। সম্ভবত রেবা ঘাটের শেষ প্রান্তে চলে গিয়েছিল। পা ঝুলিয়ে বসেছিল। অসাবধানে হঠাৎ জলে পড়ে যায়। অনেকক্ষণ দেখা না পেয়ে বাড়ির সবাই রেবাকে এদিক-ওদিক খোঁজা শুরু করেন। প্রতিবেশীদের ঘরেও পাওয়া গেল না তাকে। অবশেষে মৃণাল সেনের মেজদা নামলেন পুকুরে। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া রেবার দেহ জলের তলা থেকে টেনে আনলেন। 

    মাত্র পাঁচ বছর বয়সের একটি প্রাণ অকালে ঝরে গেল। পাড়ার সবাই ভিড় করল মৃতদেহ দেখতে। রেবাকে সমাহিত করা হয় ওই বাড়ির মাটিতেই। খবর পেয়ে শহর থেকে বাড়ি ফিরলেন মৃণালের বড়ো দাদা শৈলেশ। সঙ্গে গেলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু কবি জসীমউদ্দীন। মৃণালেরা তাঁকে জসীমদা বলে ডাকতেন। রেবাকে জসীমউদ্দীন স্নেহ করতেন খুব। সবার থেকে ঘটনা শুনে পুকুর ঘাটে চলে গেলেন তিনি। সারাদিন বসে রইলেন সেখানেই। চা খেতে বলা হল, খেলেন না। দুপুরবেলা খাবার ছুঁয়ে দেখলেন না। 

    সন্ধে হওয়ার মুখে মৃণালের মা সরযূবালা ডেকে পাঠালেন জসীমউদ্দীনকে। তারপর নিজেই গেলেন ঘাটে। সরযূবালাকে জড়িয়ে জসীমউদ্দিন শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন। দু’জনে কিছুক্ষণ বসে থাকেন ঘাটে। তারপর জসীমউদ্দিন বলতে থাকেন রেবার নানা গোপন কথা, যেগুলো একমাত্র তিনিই জানতেন। মাসখানেক আগে রেবা বলেছিল তাঁকে।

    সন্ধের পর ঘাট থেকে ওঠেন দু’জন। সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ থেকে জসীমউদ্দিন রওনা দেন নিজের গ্রাম গোবিন্দপুরের দিকে। তার আগে সরযূবালাকে দিয়ে যান একটি দীর্ঘ কবিতা। ঘাটে বসে লিখেছিলেন। সরযূবালাকে বলেন, “এ কবিতাটিতে রেবার কথা আছে। এ কবিতাটি কখনই ছাপবেন না। এ কবিতাটি শুধু আপনার জন্য।”

    সযত্নে একটি খামের মধ্যে কবিতাটি রেখে দেন মৃণাল সেনের মা। ১৯৭৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। শ্মশানে তাঁর মরদেহের সঙ্গেই ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল সেই কবিতা।
     
    ফরিদপুরের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার সময়ে মৃণালের বাবা দীনেশ সেন ওই বাড়ির নতুন মালিককে বলেন, “একটা ছোট্ট অনুরোধ করছি। আমার ছোটো মেয়ে রেবার একটি স্মৃতিসৌধ আছে পুকুরের ধারে। সে আমার পাঁচ বছর বয়সের সবার ছোটো মেয়ে, জলে ডুবে মারা যায়। পারলে এ স্মৃতিসৌধকে রক্ষা কোরো।”

    অনেক বছর পর ১৯৯০ সালে ফরিদপুরের সেই পুরোনো ভিটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মৃণাল এবং তাঁর স্ত্রী গীতা। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা একগুচ্ছ ফুল গীতার হাতে দিয়ে বললেন, “আপনি শ্বশুরবাড়িতে এসছেন। আসুন। সেই পুকুরপাড়ে। যাবেন তো?” রেবার কথা ইতিমধ্যেই গীতা শুনেছিলেন মৃণালের থেকে। ভদ্রমহিলা বলতে থাকেন, “চলুন, রেবাকে মনে পড়বে। আপনাদের বাবার কথা আমরা রেখেছি। ভাঙচুর একটু-আধটু যা হয়েছে, তাও সারিয়েছি।”

    মৃণাল কিছু বলতে যাচ্ছিলেন গীতাকে, কিন্তু গলা আটকে গেল। তাঁর চোখ তখন ভিজে উঠেছে জলে। 

    ঋণ – ‘মৃণাল সেনের আত্মজীবনী’, ফিল্মফ্রি। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @