মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ : পড়াশোনা, ভেষজ চাষ, স্বচ্ছতা অভিযান সবেতেই কৃতি এই স্কুল

পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লক, এক সময়ের এখানকার মৌপাল মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা বলে খ্যাত ছিল। মাওবাদী-জমানায় এক সময় এখানকার মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের (Moupal Deshapran Vidyapith) শিক্ষকদের কাছে ফোনে হুমকি আসত এই বলে, যে ‘আজ বনধ ডেকেছি, আপনারা স্কুল খোলা রেখেছেন কেন? তাড়াতাড়ি স্কুল বন্ধ করুন’। তখন স্কুলের শিক্ষকরা কোনওমতে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে সেদিনের মতো স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য হতেন।
এর ফলে আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের প্রয়াসে বাধা পেতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। তবে সেই সমস্যা কেটে গেছে রাজ্য সরকারের বদান্যতায়। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে জনসাধারণের কমিটির নেতা কিষেনজির মৃত্যুর পর মাওবাদী আধিপত্য জঙ্গলমহলে আর নেই, তাই হুমকি দিয়ে আর ফোনও আসে না মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠে। ১৯৫৫ সালের ২ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত হয় মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ (উ.মা.)। তখনও স্কুলটি সরকারি অনুমোদন পায়নি। পায় ১৯৬৪ সালে। তবে, স্কুলের প্রতিষ্ঠা-বর্ষ ধরা হয় ১৯৫৫, ২ জানুয়ারীকেই। স্কুল-ক্যাম্পাসে একটি প্রাথমিক স্কুলও আছে। সেটি ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রাথমিক স্কুলটির ভিত্তি একই তবে স্কুলের পঠনপাঠন, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবটাই আলাদা। এই প্রাথমিক স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন বনওয়ারী লাল রায়, তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত। তাঁর উদ্যোগেই এই মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যালয়ের জন্ম। স্থানীয় কিছু যুবককে নিয়ে তিনি আজকের এই মৌপাল দেশপ্রাণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শুভারম্ভ করেন।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই নয়, আঞ্চলিক সংস্কৃতি নিয়েও চর্চা হয় এই স্কুলে। সরকারিস্তরে সমগ্র শিক্ষা মিশন কলা উৎসব করে, তাতে অংশ গ্রহণ করে নাটক ও আদিবাসী সংস্কৃতি নির্ভর নৃত্য বিভাগে অংশগ্রহণ করে জেলা স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে মৌপাল দেশপ্রাণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ।
স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক প্রসূন কুমার পড়িয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল স্কুলের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে। আচার্য্যরত্ন, শিক্ষকরত্ন সম্মান পেয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমাদের স্কুলটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনি ব্লকের মৌপাল-এ, এই মৌপাল এক সময় মাওবাদী অঞ্চল বলে কুখ্যাত ছিল। ২০১০ সালে আমি এই স্কুলে যোগ দিই। সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসেই আমাদের স্কুলের দু’জন মাওবাদীদের হাতে খুন হয়ে যান, একজন তৎকালীন স্কুলের সভাপতি পশুপতি সিং, আর একজন ছিলেন প্যারাটিচার রহিম পাতর। তখন স্কুল স্বাভাবিক নিয়মে চলতে চাইলেও চলতে পারতো না। বেশিরভাগ দিন হুমকি দিয়ে ফোন আসত স্কুল বন্ধ করার জন্য। আমরা বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধ করে দিতাম। একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে স্কুলটি চলছিল। ২০১১-সালে রাজ্যে সরকার বদলের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়।”
প্রধান শিক্ষক প্রসূন কুমার পড়িয়া
প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকেই জানা গেল, স্কুলটিতে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন চলে। স্কুলে ছাত্রাবাস আছে, নাম রবীন্দ্র শিক্ষার্থী আশ্রম, ২০০৪ সালে হোস্টেলটি চালু হয়। এই বছর ১৪৮ থেকে ১৪৯ জন ছাত্র বর্তমানে এই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে। এই স্কুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হয়। কৃষি ও ইলেকট্রিকাল বিভাগে পড়ানো হয়। ২০০৬ সাল থেকে এই বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। বর্তমানে দুটি বিভাগ মিলে ৫০ থেকে ৮০-র মধ্যে থাকে। আর পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের ছাত্রী-ছাত্রী সংখ্যা ১২৮০। শিক্ষক ২৫ জন, অশিক্ষক কর্মীর সংখ্যা ৬ জন। অশিক্ষক কর্মচারীর ৩টি পদ ফাঁকা। শিক্ষকের অভাবও আছে। বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ পড়ান হয়। এই মুহূর্তে ৬ থেকে ৭ জন শিক্ষক আছেন। ২০১০ সালে স্কুল যখন উচ্চমাধ্যমিক হয়, তখন থেকেই এই শিক্ষকের প্রতুলতা শুরু হয়েছে। মাধ্যমিক বিভাগের শিক্ষক এবং পার্টটাইম শিক্ষক দিয়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কিছু ক্লাস চালানো হয়।
“এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এসসি, এসটি ৬০% আর ওবিসি ৯৫%। আমরা চাইছি পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসতে। আমাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই আজ শিক্ষকতা করছেন, কেউ বিদেশে গবেষণা করছেন, কেউ বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। মূলস্রোতে তাঁদের পৌঁছে দিতে আমরা পেরেছি। এখনও পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ৯৪ থেকে ৯৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী পাশ করেছে। আমরা চাই ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ভিতর রাখতে। তাই অভিভাবকদের নিয়ে আমরা দুটো সভা বছরে করি। স্কুলছুট তেমন সংখ্যায় নেই। তবে স্কুলটি যে এলাকায়, সেখানে বাল্যবিবাহের একটা প্রচলন আছে। এই বছরই আমাদের স্কুলের একটি মেয়ে নিজেই তার বিয়ে আটকে প্রশসংসিত হয়েছে, জেলাশাসক ওই মেয়েটিকে এক রকমের সংবর্ধনা দিয়ে ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন। আদিবাসী সমাজের অশিক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য তাদের মধ্যে এই বাল্যবিবাহের প্রচলন এখনও আছে। আমরা সেটাকে আটকাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এর জন্য আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা স্কুলের সময়ের বাইরেও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাড়তি সময় দেন।” বলছিলেন প্রসূন কুমার পড়িয়া।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আনার জন্য কী অকল্পনীয় পরিশ্রম এই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা করে চলেছেন, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শিক্ষকের দায়িত্ব সমাজ গঠন, এই স্কুলে সেই কাজটাই শিক্ষক-শিক্ষিকারা করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে, নিরলস ভাবে।
এই স্কুলে যারা পড়তে আসে তাদের মধ্যে ৯৫% অংশই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। এদের বাবা, মায়েরা সরকারি চাকুরে ২ থেকে ৩%। প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া ২৫ থেকে ৩০%-এর বেশি, কম নয়। সর্বশিক্ষা মিশনের সহায়তায়, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি ক্লাস রুম গড়ে তোলা হয়েছে স্কুলে। এর মধ্যেই ল্যাবরেটরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্লাস, ওয়ার্কশপ, কম্পিউটার ল্যাবরেটরি সবই আছে। আরও কিছু ক্লাসরুম হলে ভালো হয়, বলছিলেন প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক জানালেন, “এলাকাটা যেহেতু মাওবাদী এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল, বহু মানুষ জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই রকম ৩ একর জমি আমরা কিনি মানুষের সাহায্য নিয়ে, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকদের আর্থিক সহযোগিতায়। এই জায়গায় আমরা জাতীয়স্তরের না হলেও একটি ভালো খেলার মাঠ করেছি। এছাড়া অডিটোরিয়াম করার জন্য একটি সংস্থা সহযোগিতা করছে। মিনি ইন্ডোর গেমস কমপ্লেক্স, সাইকেল স্ট্যান্ড, নতুন একটি স্কুল ভবন, হোস্টেলের জন্য একটি ভবন তৈরি করেছি। লাইব্রেরি আছে তবে সেটা রিডিং রুম নয়। আগামী দিনে ১০০ জন পড়ুয়া যাতে বসে পড়তে পারে তার জন্য ভাবনাচিন্তা চলছে। একটা সেমিনার হল করার ইচ্ছাও আছে।”আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই নয়, আঞ্চলিক সংস্কৃতি নিয়েও চর্চা হয় এই স্কুলে। সরকারিস্তরে সমগ্র শিক্ষা মিশন কলা উৎসব করে, তাতে অংশ গ্রহণ করে নাটক ও আদিবাসী সংস্কৃতি নির্ভর নৃত্য বিভাগে অংশগ্রহণ করে জেলা স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে মৌপাল দেশপ্রাণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের খেলা, সংস্কৃতি চর্চা, বাগান রক্ষনাবেক্ষন, পরিচর্যায় প্রশিক্ষণ দেন। সুব্রত কাপে অংশ গ্রহণ করে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই স্কুল। এই দুই বিভাগে রাজ্যস্তরেও অংশগ্রহণ করেছে। ইয়ুথ পার্লামেন্ট-এ অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেয়েছে স্কুলটি। জেলাস্তরে তাতে তৃতীয় হয়েছে এই স্কুল।
স্কুলের সবজি বাগান, ভেষজ উদ্যান আছে, ফুলের বাগান আছে। এই বাগানের সবজি হোস্টেলে, মিড-ডে মিলে ব্যবহার হয়। তবে যেহেতু আদিবাসীরা তাদের নিজেদের ভাষা ছেড়ে বাংলা, ইংরেজি পড়ছে এই স্কুলে তাই তারা যাতে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত না হয় সেদিকে স্কুলের নজর আছে। আর তাই তাঁরা আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চার কাজটা স্কুল পুরোদমে করে চলেছে। স্কুলে একটি আর্ট গ্যালারি আছে। সেখানে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের শিল্পকর্ম তুলে ধরা হয়। আছে মাল্টিজিম। দেওয়াল পত্রিকা স্কুলে, হোস্টেলে আছে, তিনটি ভাষায় ম্যাগাজিন বার হয়।
এছাড়া স্কুল শুরুর সময় প্রার্থনা সভা হয়, সেখানে দিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা হয়। শিশু সংসদ, বন্ধু মহল, কন্যাশ্রী ক্লাব আছে, স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণি হাউস-এর মাধ্যমে বিভক্ত করা হয়েছে। এই হাউস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রানী শিরোমণি, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আর আশাপূর্ণা দেবীর নামে আছে। প্রতিটি হাউসের জন্য আলাদা রঙের আইডেন্টিটি কার্ড চালু করার ইচ্ছা আছে স্কুল কর্তৃপক্ষের। ২০২৩-সালে এই চারটি হাউস চালু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহিত করা, স্কুলে ধরে রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ও অন্য শিক্ষকরা। এই স্কুল এর ফলে নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার পেয়েছে গত ২০১৩ সালে। ২০২২ সালে পরিদর্শন হয়েছে শিশু মিত্র পুরস্কারের জন্য, এটা সমগ্র শিক্ষা মিশন থেকে করা হয়। মেদিনীপুর সদর মহকুমার সেরার সেরা স্কুলের পুরস্কার পেয়েছে এই স্কুল, স্কুল পরিদর্শকদের একটি সংগঠন এই পুরস্কার দেয়। এই সংগঠন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষককে ‘বিদ্যাসাগর জাতীয় শিক্ষক’ সম্মান প্রদান করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন শৌচালয়, করোনাকালীন প্রস্তুতি ও প্রতিরোধের ব্যবস্থার জন্য ২০২২-এ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার পেয়েছে এই স্কুল। স্কুলের শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির পড়ুয়াদের মূল স্রোতে আনার যে কাজ করে চলেছেন সেটা প্রশংসার দাবি রাখে।
____________________________________
তথ্যসূত্র: ডঃ প্রসূণ কুমার পড়িয়া, প্রধান শিক্ষক, মৌপাল দেশপ্রাণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ
ছবি: সংগৃহীত
*কলকাতা, শহরতলি বা জেলার কোনও না কোনও স্কুলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গর্বের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বুনিয়াদি গল্প। এবার সেদিকেই ফিরে তাকিয়ে চলছে নতুন ধারাবাহিক ‘আমাদের ইস্কুল’। সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। চোখ রাখুন প্রতি বুধবার সন্ধে ৬টায়, শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে।