No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মোমো চিত্তে : মৌমিতা মিস্ত্রি’র উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলাচালিত মোমো-ব্র্যান্ড

    মোমো চিত্তে : মৌমিতা মিস্ত্রি’র উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলাচালিত মোমো-ব্র্যান্ড

    Story image

    বিগত দশ বছরে ডাল-ভাতের মতোই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে মোমো। বাঙালির মোমোপ্রীতি আর রবি ঠাকুরের প্রতি প্রেমের মিশেল ঘটিয়েছেন বাংলার এক কন্যে। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘Momo চিত্তে’। মোমো তাঁর জীবনের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যে সামাজিক মাধ্যমে নিজের নামের মধ্যাংশে ‘মোমো’ ব্যবহার করেন – মৌমিতা মোমো মিস্ত্রি। পশ্চিমবাংলার সবাইকে নিজের ব্র্যান্ডের মোমো খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন অজয়নগরের খুব সাধারণ এই মেয়ে। দুর্গাপুজোর আগে পঁচিশটি এবং এ বছরের মধ্যে ত্রিশটি আউটলেট তৈরির টার্গেট নিয়েছেন। মোমো-কে ঘিরে সমাজের ছক ভেঙেছেন মৌমিতা।

    মৌমিতার সফর, সফলতা; তাঁর এলাকায় আন্দোলনের মতো হয়ে উঠেছে। তাঁকে দেখে মেয়েরা স্বনির্ভর হতে বেছে নিচ্ছেন বাণিজ্যের পথ। কর্মী নয় কর্মদাতা হয়ে উঠছেন বাংলার মেয়েরা। মৌমিতাদের কর্মযজ্ঞে বাঙালি জাতির বানিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে প্রতিনিয়ত।

    বাড়ির সকলেই সরকারি চাকরি করেন। ছোটোবেলা থেকে তাঁকে বোঝানো হয়েছিল সরকারি চাকরি করতে হবে, স্থায়ী উপার্জন চাই। যৌথ পরিবারের মেয়ে মৌমিতা চাকরি করলেও, সব সময় ভাবতেন নিজেকে কিছু করতে হবে। সে সুযোগ এসে পড়ে লকডাউনে। কিন্তু ঠেলাগাড়িতে একটি মেয়ে খাবার বিক্রি করবে! আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধবরা বাঁকা চোখে দেখেছেন, ভেসে এসেছে বাঁকা কথা, মৌমিতার দোকানে অবধি যাননি তাঁরা। আজ তাঁরাই মোমো চিত্তে ও মৌমিতাকে নিয়ে গর্ব করেন। পাশে পেয়েছিলেন বাবা-মা, তদানিন্তন প্রেমিক অধুনা জীবনসঙ্গী বিদ্যুৎ হালদার ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের। সঙ্গে ছিল কিছু করে দেখানোর তাগিদ ও অদম্য জেদ। সফল এন্টারপ্রেনিওর হয়ে উঠলেন তিনি। একটি বেসরকারি সংস্থার সাধারণ একটি চাকরি ছেড়ে এখন তিনি বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছেন, বিশেষত মহিলাদের। কর্মী থেকে কর্ম-উদ্যোগ স্রষ্টা হয়েছেন। আজ প্রায় পঞ্চাশের বেশি পরিবার তাঁর উপর নির্ভরশীল।একুশ শতকের গত এক দশককে স্টার্ট আপের যুগ বলা যায়। প্রায় প্রতিদিনই নিত্যনতুন কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। একক উদ্যোগে হোক বা যৌথভাবে বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত, সহ-কর্মীরা মিলে নিজেদের কিছু করার তাগিদ থেকে তৈরি হচ্ছে স্টার্ট আপ, তেমনই মোমো-কে কেন্দ্র করে মৌমিতা মিস্ত্রি গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব ব্র্যান্ড। বঙ্গদর্শন.কম-কে তিনি বলেন, “‘মোমো চিত্তে’ই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা চালিত মোমো-ব্র্যান্ড ইতিমধ্যেই যার আউটলেটের সংখ্যা আঠারো। বাইপাসের ধারে, সার্ভিস রোডে ঠেলাগাড়িতে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল লকডাউন। লকডাউন না হলে হয়তো স্টার্ট আপ করতাম না।”
     
    মৌমিতা মিস্ত্রি ও তাঁর জীবনসঙ্গী বিদ্যুৎ হালদার

    বছর চারেকের মধ্যেই মৌমিতা হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা, আজ তাঁকে দেখে মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন বাণিজ্য করার স্বপ্ন নিয়ে। মৌমিতা এঁদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগী হিসেবে দেখেন না। তাঁর কথায়, “ওঁরা প্রত্যেকেই আমার খুব প্রিয়। আমার পরিবারের মতোই হয়ে গেছে। কেউ কেউ এগরোল, চাউমিন দিয়ে শুরু করেছেন। ওঁরা যে করছেন এটাই বড়ো কথা।” মেয়েরা বেশি করে মৌমিতাকে দেখে এগিয়ে আসছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন। মোমো চিত্তের আঠারোটা আউটলেটের মধ্যে একটা-দুটো আউটলেট ছাড়া প্রায় সবগুলোতেই মহিলারা কাজ করেন। কাজ করার জন্য আলাদা কোনও ডিগ্রি বা যোগ্যতার দাবি নেই তাঁদের। মৌমিতার কথায়, একটাই চাহিদা, মেয়েরা সুন্দর করে গুছিয়ে কাজ করবে। নিজেই বললেন, “মেয়েরা কাজ করছি। কেউই মাস্টার শেফ নই। এমনভাবেই পদগুলো রেখেছি, যাতে খুব সহজে ভেজে, বেক করে পরিবেশন করা যায়। মোমোর পাশাপাশি বার্গার, স্যান্ডউইচ, পিৎজা, ফ্রাই, মকটেল ইত্যাদি রেখেছি।”

    বাঙালি বাণিজ্য করতে পারে না-এ ধারণাকে ডাহা মিথ্যে মনে করেন মৌমিতা। স্টার্ট আপ নিয়ে কথা হচ্ছিল মৌমিতার সঙ্গে, বলছিলাম এখন সবার মধ্যে ‘এন্টারপ্রেনিওর’ হওয়ার তাগিদ দেখা যায়। সব্বাই নিজের প্রোফাইলের সঙ্গে ‘ফাউন্ডার’ ট্যাগ জুড়ে নিতে চান। এই প্রবণতার কারণ কী? মৌমিতার মতে, “এখন চাকরির বাজার খুব খারাপ। বেসরকারি কোনও কাজ করলে দশ-বারো হাজার টাকা বেতন পাওয়া যায়। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বারো ঘণ্টা অন্যের অধীনে কাজ করতে গিয়ে যা আয় করা যায়, স্বাধীন ভাবে নিজের কাজ করে তার থেকে দ্বিগুন আয় করা সম্ভব।”

    একটি স্টার্ট আপে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কোনটা জরুরি? মৌমিতা জানাচ্ছেন, সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, সেটা হল ধৈর্য্য। ধৈর্য্য ধরে থাকতেই হবে। আজকে মানুষ চিনছে না, আসছে না, কিন্তু একদিন আসবেই। ভালো প্রোডাক্ট দাও, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো, তুমি সফল হবেই। সঙ্গে ভাগ্য তো আছেই। নিজের শুরুর দিনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বললেন, “যখন শুরু করেছিলাম, কোনও কারিগর ছিল না। নিজেই বানাতাম। সার্ভিস রোড, ফাঁকা জায়গা, কোনও শেড নেই। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সঙ্গী। দোকানদারি করেছি, বিক্রি হয়নি, হাল ছাড়িনি। শুধু জানতাম, আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।” 

    ঠেলাগাড়িতে এভাবেই শুরু করেছিলেন

    মোমো চিত্তের সফলতা প্রসঙ্গে তাঁর মত, কলকাতায় প্রথম ফিউশন মোমোর ধারণা এনেছিল মোমো চিত্তে, ২০২০ সালে। এখন হয়তো অনেকেই করে। এই মুহূর্তে তাঁদের কাছে আশি রকমের মোমো পাওয়া যায়। একটা মোমো-কে বিভিন্ন ভাবে ক্রেতাকে পরিবেশন করা যায়, এই ধারণা এনেছিল মোমো চিত্তে। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোমোট করি, আমার মৌমিতা মিস্ত্রি প্রোফাইলে। কোনও ব্লগার বা কোনও কিছু নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল নিজের প্রোফাইলেই প্রোমোট করা শুরু করেন। মানুষের ভালো সাড়াও পান। 

    যেসব তরুণ-তরুণীরা একদিন নিজের ব্যবসা গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে মৌমিতার পরামর্শ, “নিজেরা যেটা ভালোবাসেন সেটা করুন। এখন আমার সব আউটলেট মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি কর্মচারী। উনত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন আমার ব্র্যান্ড মাসে তিন লক্ষ টাকার বেশি স্যালারিই দিচ্ছে। নিজেকে রিস্ক নিয়ে সেই জায়গাটা ছাড়তে হবে, আর জেদ থাকবে যে আমি করবো। সঙ্গে ধৈর্য্য তো রয়েইছে। সম্পূর্ণ তাঁর উপর নির্ভর করছে, সে এই ঝুঁকিটা নেবে কিনা! ফিক্সড স্যালারি ছেড়ে ব্যবসায় আসার ঝুঁকি নেবে কিনা।”

    হাইল্যান্ড পার্কের আউটলেট

    একেবারে প্রথম দিকের কথা জানাচ্ছিলেন মৌমিতা, আক্ষরিক অর্থেই তাঁর শুরু শূন্য থেকে। তাঁর নিজের কথায়, তখন জায়গাটা কেউ চিনত না। সকালে তিনি অর্ডার নিতেন আর বিকেলে বিদ্যুৎবাবু (তাঁর জীবনসঙ্গী) স্কুটারে করে ডেলিভারি করতেন। এইভাবে শুরু। তারপর চাহিদা বাড়তে ২০২০-তে পুজোর আগে অজয়নগর থেকে হাইল্যান্ড পার্কে আসা। মৌমিতা চেয়েছিলেন, এমন একটা জায়গায় দোকান করতে যেখানে মানুষ রাস্তা থেকেও ‘momo চিত্তে’ লেখাটা দেখতে পাবে। সেই মতো চল্লিশ স্কোয়ার ফুটের একটা দোকান ভাড়া নিয়ে, নতুন জার্নি শুরু করেন। কিন্তু কিছু অসুবিধার কারণে সেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। আবার ওই বছরই ডিসেম্বরে হাইল্যান্ড পার্কের দোকান ফের শুরু করেন। এবারে একটু আঁটঘাট বেঁধে। প্রোডাকশন বাড়তে কারিগর নিয়োগ করেন। বাপের বাড়ির ছাদে ত্রিপল খাটিয়ে কিচেন বানান। মৌমিতা বলেন, “তারপর থেকে চলছে, মানুষ চিনেছে ওখান থেকেই।”

    মোমো-চিত্তের পেরিপেরি মোমো

    মৌমিতা বলছিলেন মানুষ মোমো চিত্তে-কে চিনেছে হাইল্যান্ড পার্ক থেকে, তাই তিনি হাইল্যান্ড পার্কের দোকান ছাড়তে পারবেন না কোনওদিন। একশো আউটলেট হলেও তিনি প্রথম দোকানটা রাখতে চান। হয়তো এ কারণে বাঙালিদের আবেগপ্রবণ বলা হয়। এই আবেগটাই বাঙালির শক্তি। বলা ভালো বাড়তি ইউএসপি। মৌমিতার সফর, সফলতা; তাঁর এলাকায় আন্দোলনের মতো হয়ে উঠেছে। তাঁকে দেখে মেয়েরা স্বনির্ভর হতে বেছে নিচ্ছেন ব্যবসার পথ। কর্মী নয় কর্মদাতা হয়ে উঠছেন বাংলার মেয়েরা। মৌমিতাদের কর্মযজ্ঞে বাঙালি জাতির বানিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে প্রতিনিয়ত।

    ছবি কৃতজ্ঞতা:
    মৌমিতা মিস্ত্রি

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @