No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা

    মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা

    Story image

    মণীন্দ্র গুপ্ত 

    বিধবা
    তুলোর বালিশ অনেকদিন নেই, সোঁদালের ফুল রোদে শুকিয়ে
    খোলে ভরে নিয়েছি।
    সেই বালিশে শুয়ে দুপুরে তন্দ্রা মতো এল।
    তন্দ্রার মধ্যে চিন্তা জড়িয়ে ওঠে
    যেন তেপান্তরের মাঠে কাঁকুড়লতা আলগা মাটি ধরে ধরে এগোচ্ছে।
    শাশুড়িমা যেন এখনও বেঁচে আছেন-
    ধান সেদ্ধ করার সময় যেমন বলতেন, ডানের মতো, তেমনি যেন বলছেন-
    এই ধান সব জ্যান্ত, অমর।
    এইবার গরম জলে সেদ্ধ হয়ে মরবে।
    মরা জিনিস ছাড়া মোদের মুখে কিছু রোচে না।
    বালিশের সোঁদাল ফুল-বীজ জ্যান্ত। তন্দ্রার মধ্যে শিকড় চারিয়ে
    আমার চারপাশে ঝটপট গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
    মাথায় ঘন হয়ে ধরল ছায়া। সেই সোনা-হলদে ফুল
    ফুটে উঠল স্তবকে স্তবকে, ঝরে পড়তে থাকল
    বিছানায়, আমার গায়ে।

    জেগে উঠে দেখি, সন্ধ্যা উতরে গেছে। কোথায় কে!
    স্বামীপুত খেয়ে বসে আছি।
    অনাথা বিধবা। জ্যান্ত মরা সবই খাই।

     

    বিড়ালী
    বেড়ালটা সকাল থেকে কাঁদছে
    কাল থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ।
    আমি রাতের বেলা রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করছিলাম,
    সে শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জোড় করে বসল।
    কিন্তু হল না।
    একটু পরেই সে মিউমিউ করে আবার কাঁদতে লাগল,
    পাগলের মতো প্রদক্ষিণ করে ঘুরতে লাগল।
    আর পুত্রশোক আগুনের মতো ঘিরে ধরল
                                      রামকৃষ্ণদেবকে।

     

    এখন ওসব কথা থাক
    এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
    ওসব কথা এখন থাক।
    এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
                                                    চলো খেয়ে আসি।
    লাল রুখু চুল
        সূর্যাস্তের মধ্যে
             অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
                   -দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি।

    সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীণ শরীরে
    আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি-
                          জলস্রোত ক্রমশ তীব্র... কনকনে...

     

     

    স্বামী -স্ত্রী
    এসো, শুতে এসো। একা বিছানায় ভয় করে। অন্ধকারে পাশে থাকো।
    পায়ে সায়েটিকার ব্যথা। পায়ের উপর তোমার ভারী জানু চাপিয়ে রাখো।
    ঘুম আসে না।
    আঙুলে আঙুল জড়িয়ে চাপো, কানের পিছনে হালকা করে ফুঁ দাও।
    ভয় করে। অন্ধকারে পাশে থাকো।
    টাকপড়া মাথা – এখনো পাঁচ-দশটা চুল শীতে কুঁকড়ে আছে-
    স্তনের তলায়, বুকে চেপে ধরতে ধরতে বলছ শুনতে পাই ;
       আহা, এখনো মাথাটা তলতলে-
           আহা, সাত দিনের শিশুর মতো ব্রহ্মতালু দিপদিপ করছে।
    হয়তো ঘুম আসছিল, কিন্তু এই কথা শুনে চোখের কোটরে
                                                  মণি স্থির হয়ে গেল ।
    কালকে দোল। আজ শুক্লা চতুর্দশী।
    চাঁদ সেই গর্তে পাতকুয়োর পুরনো জলে চিকমিক করছিল
    তোমার বগলের ফাঁক দিয়ে আমি তাকিয়ে দেখছি।

    বিয়ের আংটিটা কুয়োয় ফেলে দাও-
    চাঁদের বুকে সেটা কাঁকড়ার ছানার মতো আটকে থাকুক,
    কাশের ডাঁটায় বিঁধে বিঁধে দ্রোণের মতো একজন কেউ
    একদিন তাকে ঠিক তুলে আনবে।
        এসব কি ভয়-পাওয়াদের রাতের স্বপ্ন? না কি
        ব্রহ্মতালু-দিপদিপ-করা শিশুর দেয়ালা?

    পরের বছর
    অ্যানাটমি ক্লাসে ফর্মালিন–এ চুবনো শবের হাত-পা কাটা হচ্ছে,
    নাড়িভুঁড়ি টেনে বার করা হচ্ছে-
    ছেলেমেয়েরা চলে গেলে সে টেবিলে শুয়ে ঘুমঘুম গলায় বলছে;
                   খোকা মাকে শুধায় ডেকে
                 ‘এলেম আমি কোথা থেকে,
                 কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।‘
    বলতে বলতে সে একা-ঘরে উঁচু সিলিংয়ের দিকে
    তাকিয়ে থাকে, শব্দহীন গলায় ককিয়ে ককিয়ে ডাকে;
                  এসো, শুতে এসো
                  একা বিছানায় ভয়  করে
                  অন্ধকারে পাশে থাকো।

     

    অশ্রু
    পাখির মরণ যখন ঘনিয়ে আসে
    তখন তার ডাকের মধ্যেও ব্যথা ফুটে ওঠে।
    মাঠের কাকতড়ুয়ারাও তা বোঝে, সারা রাত তাদের হাঁড়িমাথায়
    শিশির পড়ে পড়ে ভোরবেলায় চোখ ভিজে উঠেছে।
    হেমন্তের ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে তারা দেখে – কৃষক আসছে,
    গোরু আসছে। ওদের চুনে আঁকা চোখ কি শেষ পর্যন্ত
    আমার জ্যান্ত চোখের চেয়েও অনুভূতিপ্রবণ হল!
    আমার কেউ আসেও না, যায়ও না।
    রাত্রে গোরের থেকে যারা ওঠে তাদের কান্না কে শুনেছে!
    যাবার আগে, আমার শেষ সান্ধ্যভোজের শক্ত পাঁউরুটিটুকু
    অন্তত যাতে ভেজে,
    আমি সেইটুকু চোখের জলের অপেক্ষায় আছি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @