প্রথম অ্যালবাম লোকে শুনল না, তারপর আরও জেদ চেপে গেল মহীনের

গত পর্বে
সমর এইচএমভি স্টুডিও থেকে রেকর্ডিং করে আর কোম্পানির লেবেলটা বসিয়ে দেয় ভারতী। তবে খরচ খরচার ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি কথা বলে নেব। তবে বাজার দর বা তার থেকে অনেক কম টাকায় তোদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আমরা দেখা করলাম সমরদার সঙ্গে খান্না সিনেমা হলের পেছনে ওঁর অফিস কাম বাড়িতে। রফা হল ৩০০ কপি ইপি ৭,০০০ টাকা। এছাড়া কভার ডিজাইন, কভার ছাপা, আনুষাঙ্গিক খরচ আমাদের। আমরা অসম্ভব মনে করে মুখ চুন করে বেরিয়ে এলাম।
পর্ব ৭
মণিদা ভীষণ জেদি ছিল। অন্যদেরও মোটিভেট করতে পারত। ডিস্ক আমরা করবোই, টাকা আমরা যেভাবেই হোক জোগাড় করব। শর্মিষ্ঠা (পরে বুলার স্ত্রী), সঙ্গীতা (পরে রঞ্জনের স্ত্রী) আমাদের কোর সদস্য দুজনেই বাড়িতে না জানিয়ে আংটি আর একটা কিছু সোনা বিক্রি করে দিল। ভানু ১২০০ বা ১৩০০ টাকা জোগাড় করল। যাই হোক, সাতে পৌঁছাতে আমাদের ২০০০ টাকা কাবুলিওয়ালার থেকে মাসিক ১০ শতাংশ সুদে তপন কাকা গ্যারেন্টার হয়ে এনে ৭০০০ পূরণ করল। ওই টাকার সুদের জন্যে যা কখনোই আমরা সময়মতো জোগাড় করতে পারতাম না। কাবুলিওয়ালা হানা মারত ভোর ছটায় তপন কাকার বাড়িতে। কাকা মধ্যরাত ৩টে-৩ঃ৩০টেয় বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে পালাত। দেড় বছর এই চোর-পুলিশ খেলা কাকাকে খেলতে হয়েছিল।
ভেসে আসে কলকাতা, মহীনের ঘোড়াগুলি, ১৯৭৭
এবার ফিরে দেখা যাক মহীনের সৃষ্টিশীলতার দিকে। এইচএমভি স্টুডিওতে তখনও স্টিরিও রেকর্ড করা যায় না। মনো রেকর্ডিং। অবশ্যই ট্র্যারক রেকর্ড শব্দটা কলকাতায় অপরিচিত ছিল।
১৯৭৭ সাল। হাতে আমরা ডিস্কের বাক্স পেলাম। উত্তেজনার শেষ নেই। অতি পরিচিতদের কাছে বিক্রি করতে গেলাম। কিছু বিক্রি হল, কিছু হল না। কেউ টাকা দিল, কেউ বলল সামনের মাসে আসিস। অনেক বাধ্যতামূলক কপি দিতে হল। কেউ কপি ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে গেল। যুক্তিঃ বেসুরো... দুইজন গায়কের গলা মিলছে না, মানে হারমোনাইজেশন।
'সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক'-এর চারটে গানের ভিনাইল ডিস্কের ভাগ্যে ব্যালেন্স শিট মাইনাস অ্যাকাউন্টে চলে গেল। এমন অবস্থায় মানুষ হতাশ হবেন না? হতে পারে? পারে। সেইজন্য মণিদার নাম গৌতম চ্যাটার্জি। ভেতর ভেতর যতই হতাশ হোক, সবাইকে চাঙ্গা করে তুলে বলল, পরের ডিস্কের প্রস্তুতি শুরু করি— রিহার্সাল আরও টাইট করতে হবে। নতুন গান তৈরি করতে হবে। কল শো'র চেষ্টাচরিত্র করতে হবে নিজেদেরই৷ পর্ণশ্রীর কালীপুজোর মাচা, যোগেশ মাইম, স্টার থিয়েটার টুকটাক কনসার্ট (তখন শো বলা হত) চলছে। শ্রোতারা আসছেন, শুনছেন — কিন্তু সেটা অনেকটা ভোরবেলা খালিপেটে চিরোতা আর নিমপাতার জল খাবার মতো শান্তি। তখন প্রচার মাধ্যম তো সীমিত। যাই হোক, ১৯৭৭ সাল কেটে গেল এভাবেই। বয়স হল আড়াই-পৌনে তিন বছর। দীপকদা (মজুমদার) লিখলেন, ঘোড়াদের খুরে এখনও নাল লাগানো হয়নি। এই সময়টার মধ্যে আমরা যৎসামান্য শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছি, কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭৮ সালে 'অজানা উড়ন্ত বস্তু' বা অউব নামে একটা এসপি ভিনাইল ডিস্ক প্রকাশ করলাম। ইনরেকোর (হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি) মার্কেটিংয়ের গৌতম সরকার (প্রখ্যাত গায়িকা সুপ্রভা সরকারের পুত্র) আমাদের গান শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। ওরা গান রেকর্ড করবে, মার্কেটিংয়ের দায়িত্ব কোম্পানির। কভার ডিজাইন, ছাপা মহীনের৷ গোটা দশেক রেকর্ড আমরা নিয়ে এলাম নিজেদের জন্য। নিজেরা শুনলাম রেকর্ডিং ভালো হয়েছে, স্টিরিও চিত্রবাণী থেকে। দেখা গেল, ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট। স্টাইল্যাস স্কিপ করছে, সরে সরে যাচ্ছে। দু-চারজনকে শুনতে দিলাম, একই 'রিপোর্ট' রেকর্ড ফেরত নিলাম।
হায় ভালোবাসি, মহীনের ঘোড়াগুলি, ১৯৭৭
আমরা অভিযোগ জানালাম। ওরা বলল, না না বিক্রি হচ্ছে তো৷ প্রতি সপ্তাহেই যাই আর শুনি, বিক্রি হচ্ছে তো৷ একটা সময়ের পর আমরা বুঝলাম ওরা মিথ্যে কথা বলছে। তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাটি খিস্তি প্রায় হাতাহাতি করে ওদের গোডাউন থেকে বাক্সগুলো ফেরত নিয়ে এলাম। ওরা একটাও বিক্রি করেনি বা করার চেষ্টাই করেনি৷ আমরা আমাদের পাড়ার অতি পরিচিত উকিল গণেশদার সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন, তোদের তো কোনও এগ্রিমেন্টই নেই! কিছুই করতে পারবি না। শুধু শুধু উকিলের খরচ, যাওয়া আসার অজস্র সময় নষ্ট। অগত্যা মেনে নিতেই হল। ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্টটা কেন হল? কী করে হল? অন্যদের রেকর্ডে তো হয় না! তাহলে কি কোনো ধরনের স্যাভোটেজ?
(চলবে...)