“প্রেমে ফিদা হলাম বিটলস শুনে”

গত পর্বে
ঘন কুয়াশায় আমার মাথার মধ্যে কীসব যেন চক্কর মারতে থাকে। মগজেই লিখে ফেলি, “ভেসে আসে কলকাতা/ কুয়াশা তুলিতে আঁকা/ শহরতলির ভোর মনে পড়ে...।”
মণিদার পছন্দ হল। তবে রঞ্জন একটা লাইন বদলালো। আর আমারও সেটা ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। জানতাম রঞ্জনের মতো অত সুন্দর শব্দচয়ন, বিশেষণের ব্যবহার আমার আসে না। রঞ্জন লিখল, “গুলতি ছোঁড়া ঘুড়ি ওড়া অগস্ট দুপুর কে দেবে ফিরে...।” বাকিটা একইরকম রেখে দিল। মণিদা সুর তৈরি করে ফেলল এক দিনেই। সেই মহীনের তৈরি করা নিজেদের প্রথম গান। নিজেদের সন্তান হাবাগোবা যাই হোক, আমাদের প্রিয়। একে ওকে ডেকে ডেকে শোনাই – প্রতিক্রিয়া শুধু ফ্যালফ্যাল করে শ্রোতার দিকে তাকিয়ে থাকা।
পর্ব ২
গল্পটা ১৯৭০-এর মার্চ। আমার বয়স তখন ১৫ বছর ৬ মাস৷ আমার জন্ম ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর। অরিজিনাল। বেহালায় যেখানে থাকি, পাশের পাড়াটা পঞ্চাননতলা, মণিদার বাড়ি। ওই পাড়াতেই আমি চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন দোকানে চাকরি জোগাড় করি৷ ক্যাশমেমো লেখার কাজ। মাস মাইনে ৮০ টাকা। আমার পড়াশোনা ও হাতখরচা। কলেজে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষ। রেশন দোকানের সময় সকাল ৭টা থেকে ১১টা, আবার বিকেল ৩টে থেকে ৬টা। বলা বাহুল্য, তিন বছরে কোনোদিন কলেজের সব ক্লাস করতে পারিনি। তবুও যেভাবে সবাই সাধারণ নম্বর নিয়ে পাশ করে, সেভাবেই আমি স্নাতক হয়ে গেছিলাম।
যাই হোক, ১৯৭০-এর কথা। মণিদা (মণিদা তখনও আমার কাছে গৌতমদা) একদিন রেশনের দোকানের ভিড় ঠেলে কাউন্টারে এসে বলল, কাজ শেষ হলে পাঁচুদার চায়ের দোকানে আমাকে আসতে। সে সময়ে আমি চা-খোর ছিলাম। প্রতি ৩০/৪০ মিনিট অন্তর ম্যানেজারকে বলে পাঁচুদার দোকানে চা খেতে যেতাম। রাস্তায় দাঁড়িয়েই। ভিতরে ঢুকতাম না। রোজই দেখতাম দশ-বারো জন দোকানের ভেতর আড্ডা মারত। মুখগুলো সব চেনা হয়ে গেছিল। ওদের মধ্যে একজন বল্টুদাকে আমি চিনতাম, ও আমার মেজদার বন্ধু ছিল। বল্টুদার কাছে গৌতমদা শুনেছিল আমি গান গাই। মায়ের কাছেই গান শিখেছি।
গৌতমদা তার কিছু আগে থেকেই পার্কস্ট্রিটে একটা পাবে গিটার বাজাত। সেই সন্ধেতে অনেক কথা হল। কথায় কথায় জানা গেল, মণিদার ছোড়দা (শিবাজীদা) আমার বড়দার সঙ্গে পড়ত। ও আমার বড়দাকেও কোনোভাবে চেনে। আরও একটা মজার কথা উদঘাটিত হল— আমার মা-র সঙ্গে যিনি তবলিয়া ছিলেন, সেই রবীনবাবুই গৌতমদার প্রথম তবলার শিক্ষক৷ এবার গৌতমদার সঙ্গে আমার পপ্যুলার মিউজিক বা ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হল। সেজন্য একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া দরকার...
হাইয়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার বছরে (আমাদের সময় ১১ ক্লাস ছিল এইচএস) জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম। (মনে হয় এখনকার প্রথম প্রেম ৪০ বছর আগেকার মতো হয় না)। মেয়েটির নাম রঞ্জনা। বাংলা পড়তে পারে না, লিখতে পারে না, শুধু কথা বলতে পারে। বাংলা গান কখনও শোনেনি। অনুষ্ঠান সূত্রে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ অথবা ‘আগুনের পরশমণি’ এই গোছের পাঁচ-সাতটা গান শুনেছিল। ভালো লাগেনি। ও প্রচুর গান শুনত, কিন্তু সবই ইংরেজি। একদিন ওর বাড়িতে নিয়ে গেল, আমার জীবনে শোনা প্রথম ইংরেজি গান— ‘I hear the sound of distant drums’। গানটা জিম রিভস-এর গম্ভীর গলায় গাওয়া। তারপর শুনলাম প্যাট বুন আরও অনেক। ভীষণ এঞ্জয় করলাম। মনে হল আমাদের বাংলার হেমন্ত মুখার্জি, দ্বিজেন ব্যানার্জি। এঁদের গলায় এইসব গান বসিয়ে দিলে তো একইরকম লাগবে। ভাষাটা আলাদা। কিন্তু এরপর যখন ও শোনাতে লাগল এভারলি ব্রাদার্স, সিসিআর, কিংস্টনট্রিয়ো আরও অনেক যুথবদ্ধ গান, তখন বুঝলাম, না এমন একটা কিছু আছে যা আমাদের (পপ/পপ্যুলার/আধুনিক) গানে নেই।
‘I hear the sound of distant drums’
এ পর্যন্ত তবুও এসব আমার কম্পাস ধরতে পারছিল। কিন্তু প্রেমে ফিদা হলাম বিট্লস শুনে। বিট্লস-এর লিরিকের ছোট্ট একটা পকেট বই দিয়ে বলল, “পড়ে দেখিস। তোদের ওই ন্যাকা ন্যাকা লিরিকের সঙ্গে অনেক তফাৎ”। এর মধ্যে আমি বাড়িতে শুনতে শুরু করেছি বব ডিলান, সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল, আরও অনেক কিছু। আমার মা-র কাছে শেখা প্রিয় গান অখিল বন্ধু ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, শচীন দেব বর্মন আরও আরও অনেক প্রিয় গায়কদের গাওয়া গান প্রায় ভুলতে বসলাম (আসলে আজও ভুলিনি)।
মণিদা একদিন সকালে (আমার ছুটির দিন) বাড়িতে এল। খাটের উপরে দুটো এলপি পড়েছিল, দুটোই বিট্লস-এর। একটা হেল্প, অন্যটা এ্যাবে রোড। অবাক হয়ে বলল, এসব কে শোনে? বললাম, আমি৷ ও হতবাক! সেই থেকে আমাদের একটা বন্ড তৈরি হল। আমি ওকে এলটন জন এলপি শুনতে দিই, ও আমাকে ট্রিনি লোপেজ দেয়।
হঠাৎ নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। ও এলাকা সে এলাকা ঘুরে আমাদের বেহালায়।
(ক্রমশ...)