“আমার অপরাধ, আমি গান গেয়েছি; তাই আইন-আদালত”

গত পর্বে
সুতপার ফিল্ম ইউনিটে ঢুকে পড়াটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। কারণ আমি আর মণিদা প্রথম তথ্যচিত্র তৈরি করি ১৯৭৯ সালে। চিত্রবাণীতে আমাদের সোশ্যাল কমিউনিকেশনের একটা ইউনিট ছিল ফিল্ম। ছবির নাম ‘দ্য প্রাইমাল কল’। বাংলার ঢাক ও ঢাকিদের নিয়ে। ড্রামস অ্যান্ড ড্রামার্স অফ বেঙ্গল। ১৯৭৯ সালের চিত্রবাণীর অ্যানুয়াল রিপোর্ট ঘাঁটলে প্রমাণটা পাওয়া যাবে।
তারপর ১৯৮২ সালের পর থেকে অনেক ফিচার, ডক্যু-তে কাজ করেছি। সেটা একটা অন্য বিষয় বলে এই লেখায় সেসবের উল্লেখ করতে চাইনি।
২০১১ সালে একটা দুর্ঘটনায় আমার এক পা স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সম্পূর্ণ বিছানায় শায়িত। বসতে পারতাম না এক বছর। গিটার ছুঁতে পারি, কিন্তু বাজাতে পারিনি। খুব কষ্ট পেতাম মনে মনে।
শেষ পর্ব
যে ডাক্তার অপারেট করেছিলেন, তিনি সুতপাকে আলাদা ডেকে বলেছিলেন – এ ধরনের অপারেশনের পর পেশেন্টের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা হতে পারে বা ডিপ্রেশনেও যেতে পারে। আমি শুনেছিলাম। কিন্তু মানসিকভাবে জানতাম, হাউ টু ফাইটেন উইথ ডিপ্রেশন। তবুও অন্য কারো কাছে না হলেও সুতপার কাছে ধরা পড়ে যেতাম। আমার চুপ করে থাকা, টেলিফোন এলে কেটে দিতাম – এভাবেই চলছিল মে মাস থেকে ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের শুরুতে অর্থাৎ এই আট মাসে প্রায় আট-নয়বার চেক-আপে আমায় যেতে হত। বিছানা থেকে স্ট্রেচার, স্ট্রেচার থেকে অ্যাম্বুলেন্স, আবার স্ট্রেচার ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তার গর্ত আর ঝাঁকুনিতে প্রাণ বেরিয়ে যায় প্রায়।
যাই হোক, ফিরে আসছি ডিসেম্বর ২০১১-য়। সুতপা আমায় একদিন বলল, “তোদের (মহীনের ঘোড়াগুলি) তো অনেকগুলো গান এখনও অপ্রকাশিত। সেগুলোর একটা সিডি অ্যালবাম বের কর।” আমি প্রথমে আকাশ থেকে পড়ি। ধীরে ধীরে মনে হল, হ্যাঁ এটা আমার করা উচিত দুটো কারণে। এক হল, আমি হতাশা থেকে বেরোতে পারব, আর মহীনের ঘোড়াগুলির অপ্রকাশিত গানগুলো শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। কিন্তু টাকা? এমনিতেই আমার অসুস্থতার কারণে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। আমরা পেশাগতভাবে ফ্রিল্যান্সার। অফিস লোন, বোনাস, এভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি, পেনশন এসব শব্দগুলো আমাদের জগতের বাইরে। এক কথায় সব দায়িত্বই নিয়েছিল সুতপা। ঘরে শুয়ে ফোনে ফোনে মিউজিশিয়ানদের ডাকলাম। বাড়িতেই রিহার্স করলাম। স্টুডিও বুক করলাম। কিন্তু সারাক্ষণই মনে মনে সন্দেহ হচ্ছিল, দাঁড়াতে পারব না, বসতে পারব না, ব্যাকরেস্ট নিতে হবে। এভাবে কি গান গাইতে পারব? একবার ভাবলাম আমি ডামিটা করে দিই। অন্য পেশাদারি ব্যান্ড গায়কদের দিয়ে ফিল্ড ট্র্যাকটা করব। সবাই হাঁই হাঁই করে উঠল – মিউজিশিয়ান, রেকর্ডিস্ট সকলে। প্রায় বাধ্য হলাম মেনে নিতে। এরপর ফ্লোরের দেওয়ালে ব্যাকরেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স তো আছেই (এই অ্যাম্বুলেন্স স্ট্রেচার, স্টুডিও ফ্লোরে ইন্টারভিউ – এসব একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেল এক্সক্লুসিভ হিসেবে টেলিকাস্ট করেছিল। ওদের আর্কাইভে নিশ্চয়ই সেইসব প্রমাণ আছে।)
আরও পড়ুন: একজন ‘ছেলেধরা’ এবং ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’র জেদ
‘ফ্যান’ অথবা ‘ভক্তকূল’ শব্দদুটো আমি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি। বরং ‘বন্ধু’ শব্দটা অনেক কাছের। ১৯৯৬ সাল থেকে বহুবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে, ওপেন এয়ারে গান গাওয়ার সুবাদে আমাকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পছন্দ করত। কী করে আমার অসুস্থতার কথা ওরা কেউ কেউ জানতে পেরেছিল। এরপর বাড়িতে হানা। আমার সঙ্গে থাকা, কখনও কখনও সারারাত। মহীনের ঘোড়াগুলির অপ্রকাশিত, অপ্রচলিত সিডি প্রকাশ পাবার পর ওরা আমাকে আর সুতপাকে সবরকম সাহায্য করেছে। সৈকত, মৈনান, পলাশ, ব্রতীণ, নীলাঞ্জনা, প্রসেনজিৎ... প্রায় ২৫-৩০ জন বইমেলায় আমাদের গান গাইতো রোজ। ২০০ কপি বিক্রি হয়ে গেছে। বইমেলা শেষের আগের দিন শনিবার আমরা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছি। সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরোবার সময়, একজন উকিলের চিঠি পাই, “এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ। সিডি রিলিজ বন্ধ করতে হবে।”
কাউকে রেপ করিনি, ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই, মার্ডার কিচ্ছু না। আমার অপরাধ আমি গান গেয়েছি। তাই আইন-আদালত।
খেলা খেলা সারাবেলার মতো দিনান্তে ঘরে ফেরা। সিডি বিক্রি বন্ধ। নতুন সাজে নতুন উৎসাহে শুরু হয়ে গেল আবার নতুন করে ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’-র দুর্গম পথ চলা।