একজন ‘ছেলেধরা’ এবং ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’র জেদ

গত পর্বে
যাইহোক, কাজটা যথারীতি আমরা পাইনি, শুধু মনে পড়ল বাচ্চুর কথাটা পড়ে। আর মনে পড়ল আমার মাস্টারমশাই দীপকদার (মজুমদার) ১৯৭৮ সালের একটা লিখিত উক্তি পড়ে – “শহরটা চলে গ্যাছে বাবু আর বেশ্যাদের দলে”।
ফিরে আসা যাক মহীনের ঘোড়াগুলি, নগর ফিলোমেল, অভিলাষা, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু, ফসিল্স, লক্ষ্মীছাড়া আরও অনেক ব্যান্ড, শহর মফস্সল গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ম্যাজিকের মতো ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ গাইতে গাইতে মধ্যবিত্তের বুক ভরছে।
“স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে
পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে
ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে,
বিষ্ণুদূতের মাথাটা দিই গুঁড়িয়ে” (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
পর্ব ১১
আগের পর্বের শেষের দিকে লিখেছিলাম, “পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে...”। এই ‘আমি’টা আমি, অর্থাৎ তাপস বাপি দাস। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি যুথবদ্ধভাবে একটা গানের দল তৈরি করার, নাম দিলাম ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’। জুটেও যাচ্ছে কেউ কেউ এদিক ওদিক থেকে, আবার ফিরে চলে যাচ্ছে। কমিউনিটি ব্যাপারটা যে বোঝাতে পারছি না, জানি। সেটা আমারই ব্যর্থতা। তাই কখনও কখনও সোলো পারফর্ম করি একটা গিটার নিয়ে। একদিন তারা মিউজিক চ্যানেল থেকে টেলিফোন আসে। তাদের ‘টেক আ ব্রেক’ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে – আমার অনুমতি চাওয়া হচ্ছে রাজি কিনা। রাজি হই। আমাকে অনুরোধ করা হয়, মহীনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত এমন কোনো একজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।
আমি হিরণ মিত্র (চিত্রকর এবং মহীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত)-কে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালাম। দু-চাকা, চার চাকা কিচ্ছু নেই। ট্যাক্সি করেই ওদের স্টুডিওতে পৌঁছালাম। অনুষ্ঠানের সময় ওরা বলেছিল বেলা ১১টা। আমাদের ডাক পড়ল বিকেল ৪টেয়। ওখানে (জায়গাটার নাম ভুলে গিয়েছি) খাবারের কোনও দোকান নেই এক মাইল রেডিয়ামের মধ্যে। লাঞ্চ করা হল না। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। শুটিং শেষ হল। আমি প্রোডিউসার ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম, আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া? ছেলেটির নাম রাজা। ও বলল, “আমরা এই অনুষ্ঠানে কাউকেই তো গাড়ি ভাড়া দিই না।” আমি ট্যাক্সি করে হিরণদাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে বাড়ি ফিরে যাই, আমার টাকায়। ৫০০ টাকাটা (আমার কাছে অনেক) যদিও কোনও বিষয় নয়, কিন্তু পেশাদারি শিল্পীর এই স্বীকৃতি দেখে শুধু নিজের প্রতি করুণা হল। বাংলার বিখ্যাত চ্যানেল। জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ/ ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ”
মহীন এখন ও বন্ধুরা
এইসব সান্ত্বনার কথা ভেবে আবার ‘ছেলেধরা’-র কাজে নেমে পড়লাম। আবার হল ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’, আবার ভাঙলো। আমি গান লিখছি, সুর তৈরি করছি, গাইছি... চলছে... এসবও চলছে। যখনই হতাশায় ভুগছি, তখনই সুতপা (আমার স্ত্রী) বিভিন্নভাবে ইমপিটাস হিসেবে কাজ করছে। আমাকে ওর টিমে, ভিড়ে যেতে বাধ্য করল, কখনো অ্যাসিস্ট্যান্ট, কখনো অ্যাসোসিয়েট, মিউজিক ডিজাইন, ডিরেকশন তো করতামই। বলা বাহুল্য, এসব কাজের জন্য পারিশ্রমিকও পেতাম। কিন্তু মাথার ভেতর একটা পোকা সারাক্ষণ কামড়াচ্ছিলঃ ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’।
সুতপার ফিল্ম ইউনিটে ঢুকে পড়াটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। কারণ আমি আর মণিদা প্রথম তথ্যচিত্র তৈরি করি ১৯৭৯ সালে। চিত্রবাণীতে আমাদের সোশ্যাল কমিউনিকেশনের একটা ইউনিট ছিল ফিল্ম। ছবির নাম ‘দ্য প্রাইমাল কল’। বাংলার ঢাক ও ঢাকিদের নিয়ে। ড্রামস অ্যান্ড ড্রামার্স অফ বেঙ্গল। ১৯৭৯ সালের চিত্রবাণীর অ্যানুয়াল রিপোর্ট ঘাঁটলে প্রমাণটা পাওয়া যাবে।
তারপর ১৯৮২ সালের পর থেকে অনেক ফিচার, ডক্যু-তে কাজ করেছি। সেটা একটা অন্য বিষয় বলে এই লেখায় সেসবের উল্লেখ করতে চাইনি।
২০১১ সালে একটা দুর্ঘটনায় আমার এক পা স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সম্পূর্ণ বিছানায় শায়িত। বসতে পারতাম না এক বছর। গিটার ছুঁতে পারি, কিন্তু বাজাতে পারিনি। খুব কষ্ট পেতাম মনে মনে।
(চলবে...)