No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, যারা অনিয়মকে নিয়ম বলে বিশ্বাস করত

    ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, যারা অনিয়মকে নিয়ম বলে বিশ্বাস করত

    Story image

    গত পর্বে

    মহীনের মতো ওরাও একইভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তবে ভাঙেনি। প্রবুদ্ধ (ব্যানার্জি) এখনও কলকাতার সেরা সংগীত পরিচালকদের একজন, নিয়মিত কাজ করে চলেছে। অমিত-ও (দত্ত) তাই। ইন্দ্রনীল সেন বলাই বাহুল্য আজও মূল স্রোতের একজন জনপ্রিয় গায়ক। সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠস্বর। ওঁদের দলে ছিল গৌতম নাগ, ইন্দ্রজিৎ সেন, রিমলি সেনগুপ্ত, সৌগত ব্যানার্জি এবং আরও কেউ কেউ ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি। যাই হোক, মহীনের ঘোড়াগুলির পর এই দ্বিতীয় ব্যান্ড (যারা অলিখিতভাবে শ্রোতাদের দীক্ষিত করতে পেরেছিল)। তারা কোথায় গেল? Where’re all those flowers gone?

    মণিদা এসেছিল চাকরি ছেড়ে দিয়ে। আমি এসেছিলাম চাকরি ছেড়ে দিয়ে। দু’জনেই বেচুবাবু। মণিদা মেডিক্যাল, আমি কনজিউমার গুডস। ও ভূপালে, আমি বম্বেতে। কিন্তু কোথায় ফিরে এসেছিলাম? ঘরে?
    “আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
    দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে
    ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে...”

    কিন্তু কী হল? কিন্তু কী হল? কথাটা দুইবার লিখলাম— আবার এই কথাটা লিখতে বাধ্য হব ১৯৯৯ সালে মণিদার মৃত্যুর কিছু সময় পরে।

    পর্ব ১০

    ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ছিল একটা কমিউনিটি, যারা তথাকথিত অনিয়মকে নিয়ম বলে বিশ্বাস করত। কোনটা নিয়ম আর কোনটা অনিয়ম, সেটা কি সূর্যের নিয়মের মতো স্বতঃসিদ্ধ? হঠাৎ নড়বড়ে, হঠাৎ সোজা মেরুদণ্ড – কখনও মেরুন সন্ধ্যালোক, কখনও ডিঙি নৌকায় বসে কাশফুলের “দে দোল দোল, দে দোল দোল/ আজি এ সাগরে তুফান তোল” বলে মেজর-মাইনর স্কেলকে মিলিয়ে দেওয়া, হয়তো ছন্নছাড়া, হয়তো মখমলের মতো স্বচ্ছ মসৃণ নয়। কিন্তু ‘নগর ফিলোমেল’ তো আমাদের মতো খাপছাড়া, হোঁচট খাওয়া, অস্বচ্ছ কোনো গানের দল ছিল না। তবে কেন শ্রোতা দর্শককূলের ওই পশ্চাদ দেখানো? তখন বুঝিনি, বুঝলাম ১৯৯৫-তে যখন ব্যান্ড মিউজিকের খরা বাজারে এল। মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ‘বছর কুড়ি পরে’ (যদিও ১৯৯৩ সালে কুট্টিদের ‘অভিলাষা’ আর শুভায়ন-সিধুদের ‘ক্যাকটাস’ ব্যান্ড – বেসিক নন ফিল্মি গান শুরু করে দিয়েছিল) ১৯৯৫-৯৬-এর বইমেলায় এক আলোড়ন সৃষ্টি করল। এই প্রসঙ্গে সংগীতশিল্পী অনুপম রায় একটা গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়েছে, “নব্বই থেকে দুই হাজারের দশকে সিনেমার গান অতটা জনপ্রিয় হয়নি। বেসিক গানটাই চলতো।” [বাংলা রক, ফেব্রু-মার্চ ২০১৮, পৃঃ ১৯]

    আইয়ুব বাচ্চুর মতে, “মিডিয়ার একটা দায়িত্ব আছে। যারা ভালো মিউজিক করছেন, তাঁদের প্রতি ওঁরা যদি একটু যত্নবান হন, একটু উদারতা দেখিয়ে তাঁদের গানগুলো নিয়মিত বাজান, তাহলে কোনও টেনশনই থাকে না। জোর করে বিষ খাওয়ালে তো মানুষ বিষ খাবেই।” [বাংলা রক, ফেব্রু-মার্চ ২০১৮, পৃঃ ১৮]

    আমার অপরিচিত। সুমন্ত নাম তাঁর। লেখক। ত্রিশ বছর বয়সী। আপাতত পিএইচডি রত। লিখছেন, “সিনেমাহলে জাতীয় সংগীত শুনলেও বসেই থাকেন, তবে রাস্তাঘাটে মহীন শুনলে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যান।” [অনন্য মহীন, পৃঃ ১৩৬]

    বাচ্চুর মিডিয়ার দায়িত্ব প্রসঙ্গে বহু পুরোনো একটা ঘটনা মনে পড়ল। সালটা ২০০২। আমি এবং সুতপা (তথ্যচিত্র নির্মাতা) দুরদর্শনের মর্নিং ট্রান্সমিশনের অফিসে গেছিলাম। একই অফিসে ওদের বেতার কেন্দ্র। আমাদের একটা অ্যাপো হয়েছিল টেলিফোনে, ডিরেক্টর মলয় পাহাড়ির রিসেপশন থেকে। (সিবিআই-এর হিসেবে ওই লোকটার শোবার ঘরের ম্যাট্রেস কেটে পাওয়া গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ ঘুষের টাকা। শালা হারামি ডিরেক্টর।) কিন্তু গেটে আমাদের আটকানো হল। পিতা-মাতা থেকে প্রপিতামহ পর্যন্ত যতরকম আইডি আমাদের ছিল, দেখালাম। সর্বোপরি অ্যাপোয়েন্টমেন্টের কথাও বললাম। পাহাড়ির নাম শুনে আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিল। আমাদের প্রজেক্ট ছিল, ‘মিউজিক সিজনাল প্রফেশন অব মার্জিনাল ফার্মার্স অব বেঙ্গল’। বারো মিনিট করে চারটে পর্ব। বছর খানেক ঘোরার পর বুঝলাম, ওটা হবে না। এই ঘোরাঘুরির মধ্যে দুইবার (দুই দিন) আমরা দেখেছি মাটিতে পড়ে আছে ব্যবহার করা কন্ডোম। যদিও রাতেও সিকিউরিটি থাকে, তবে আবাসিক বলে ওখানে কিছু নেই। মনে হল গেটে ঢুকতে না দেবার কড়াকড়ি করে কি এ জন্য? আমরা কন্ডোম দেখে ফেলব, নাকি অন্য কোনো প্রোটোকল?

    যাইহোক, কাজটা যথারীতি আমরা পাইনি, শুধু মনে পড়ল বাচ্চুর কথাটা পড়ে। আর মনে পড়ল আমার মাস্টারমশাই দীপকদার (মজুমদার) ১৯৭৮ সালের একটা লিখিত উক্তি পড়ে – “শহরটা চলে গ্যাছে বাবু আর বেশ্যাদের দলে”।

    ফিরে আসা যাক মহীনের ঘোড়াগুলি, নগর ফিলোমেল, অভিলাষা, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু, ফসিল্‌স, লক্ষ্মীছাড়া আরও অনেক ব্যান্ড, শহর মফস্‌সল গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ম্যাজিকের মতো ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ গাইতে গাইতে মধ্যবিত্তের বুক ভরছে।

    “স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে
     পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে 
    ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে, 
    বিষ্ণুদূতের মাথাটা দিই গুঁড়িয়ে”
    (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

    (চলবে...)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @