No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ৪,২০০টি বই পৌঁছে যাচ্ছে দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে, নজির গড়লেন শিলিগুড়ির এই ‘স্টার’ দম্পতি

    ৪,২০০টি বই পৌঁছে যাচ্ছে দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে, নজির গড়লেন শিলিগুড়ির এই ‘স্টার’ দম্পতি

    Story image

    রূপকথা নয়। এক্কেবারে সত্যি। অনেকসময় এই ভালোবাসা ও পাশে থাকার গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। অনির্বাণ নন্দী এবং পৌলোমী চাকি নন্দী। তাঁদের কাছ থেকে পাঠ্য বই নিয়ে বন্ধ চা বাগানের কোনও ছাত্রছাত্রী এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে। কেউ আবার মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছে। শুধু বন্ধ চা বাগান নয়, আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বহু ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে অনেকেই এই দম্পতির কাছ থেকে বই নিয়ে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। উত্তরবঙ্গের গ্রামীন এলাকা ও চা বাগানে এভাবে ‘মোবাইল লাইব্রেরি’র মাধ্যমে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছেন উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এলাকার এই দম্পতি। বই ছাড়াও গ্রামের মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি, মহিলাদের স্বনির্ভরতার জন্য মাশরুম চাষ, ঠোঙা তৈরির মতো কাজও তাঁরা শিখিয়ে চলেছেন।

    অনির্বাণ নন্দী। খড়গপুর আইআইটি-তে গ্রাম উন্নয়ন নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করছেন। আর একজন তাঁর স্ত্রী, পৌলোমী চাকি নন্দী। খড়গপুর আইআইটি-তে অর্থনীতির রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট তিনি। তাঁদের বিয়ে হয়েছে ২০১৭ সালে। আর বিয়ের কিছুদিন বাদে (২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর) মোবাইল লাইব্রেরি নিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু হয়। 

    ২০১৭ সালে শুরু হয় এই দম্পতির যাত্রা 

    অনির্বাণবাবুর বাবা অতুল নন্দী একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। মা প্রণীতা নন্দী একজন নার্স। ছোটোবেলায় স্কুলে ভর্তি হতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে অনির্বাণবাবুকে। মা অন্যের কাছে টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। আর বাবার কাছে ছোটোবেলা থেকেই অনির্বাণ শুনে এসেছেন গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের দুঃখের কথা। তাই আজ চল্লিশ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও গ্রামের কথা ভোলেননি। বলা চলে গ্রামের মানুষের জন্য ভালো কাজ করাটা এখন তাঁর নেশার পর্যায়ে পৌঁছেছে।


    ছাত্র-ছাত্রীদের বই বিতরণ

    খড়গপুর আইআইটি-তে গ্রাম উন্নয়ন নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করতে করতেই অনির্বাণবাবু নেমে পড়েন শিলিগুড়ি মহকুমার গ্রামগুলো নিয়ে। প্রথমে জামাকাপড় বিলি দিয়ে শুরু। তারপর তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আলোচনা করেন যে, গ্রামের মানুষের সার্বিক উন্নতি না করতে পারলে কিছু হবে না। খাপছাড়াভাবে হঠাৎ কিছু জামাকাপড় বিলি করে কোনও লাভ নেই। তখন তাঁরা খতিয়ে দেখেন, গ্রামের মানুষের সার্বিক উন্নতি করতে হলে তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কাজ করতে হবে। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে চাইলেও আর্থিক কারণে পিছিয়ে পড়ছে। তাই গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রত্যেককে স্বনির্ভরতার পাঠ দানের অঙ্গ হিসাবে বিনে পয়সায় মাশরুম বীজ দিয়ে চাষের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তার পাশাপাশি গ্রামীন মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার পাঠ দিয়ে বিনা পয়সায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি শুরু করেন। সেই সঙ্গে শুরু করে দেন পাঠ্যপুস্তক বিলি। প্রথমে কোথায় কার বই নেই, খুঁজে শুরু করেন বই বিলি। ২০১৮ সালে মাথায় আসে ডিজিটাল লাইব্রেরির কথা।

    লঞ্চ করা হয় একটি ওয়েবসাইট। তারপর ফেসবুক পেজ। ফেসবুকেই প্রথমে শুরু করেন কাজের প্রচার। ওয়েবসাইটে রয়েছে বুক ডোনেশন ফর্ম। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রী তাঁদের কাছে বই প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। তৈরি করেন নয় জনের বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক টিম। এবারে শহর, গ্রামের আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ শুরু করেন। আর সেসব বই নিজেরাই গাড়ি নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিলি করতে নেমে পড়েন। এখনও পর্যন্ত তাঁদের মোবাইল লাইব্রেরিতে বই সংগ্রহের পরিমাণ ৪,২০০টি। আর দেড় হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে তাঁরা বই প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পেরেছেন।

    স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ গ্রামবাসীদের 

    নিঃসন্দেহে কাজটি অত্যন্ত মহৎ ভাবনার। আর সেই কাজ করতে গিয়ে ভয়ানক ঝুঁকিও নিতে হয়েছে এই দম্পতিকে। যেমন, পৌলোমী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও গাড়ি নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে বই বিলি করেছেন। গ্রামের রাস্তায় গর্তের মধ্যে তাঁর গাড়ির চাকা বসে যাওয়ার পরও বই বিলির কাজ ছাড়েননি। এখন তাঁদের গাড়ি, বাড়ি, কার্য্যালয় সর্বত্র বইয়ের ছড়াছড়ি। যারা বই নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাদের পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন সব খতিয়ে দেখেন তাঁরা। তারপর বই প্রদান করেন। তবে যারাই বই সংগ্রহ করেন, প্রত্যেককে প্রতি তিন মাসে একবার সদস্যপদ নবীকরণ করাতে হয়। এখন আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বহু ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে অনেকেই তাঁদের কাছে বই নিয়ে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

    অনিবার্ণ-পৌলোমীর মোবাইল লাইব্রেরি 

    শুধু গ্রাম নয়, শহরের আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েরাও এই লাইব্রেরির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। আবার বহু ছাত্র-ছাত্রী এই লাইব্রেরিতে বই দানে করছেন। এইসব বইদাতাদের তাঁরা ‘স্টার ভলান্টিয়ার’ বলেন। শিলিগুড়ি মহকুমার চারটে ব্লক ফাঁসিদেওয়া, খড়িবাড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ ব্লক, কোচবিহারের বহু গ্রাম ও শহরের ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এই দম্পতি এখন অন্যরকম ‘স্টার’। বইয়ের সঙ্গে ন্যাপকিন, মাশরুম চাষ, ঠোঙা তৈরি – সব কাজ চলছে সমানভাবে। দম্পতি বলেন, “এটা এখন আমাদের নেশার পর্যায়ে পৌঁছেছে। গ্রামের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি না হলে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না।”

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @