এবার মিথ্যে বলার ঠ্যালাটা বোঝ

“না, না। আমি এগুলো চেঞ্জফেঞ্জ করে আনতে পারব না; আমার নিজেরই এখন প্রচুর কাজ। নিজে পার তো যাও, নয়তো আলমারিতেই আবার খুব যত্ন করে রেখে দাও গে”।মিলির দিতে চাওয়া পাঁচশ আর হাজার টাকার নোটগুলি ফিরিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে অফিসে রওয়ানা হচ্ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অডিট-অফিসার সুমন দত্তগুপ্ত।
গ্রিল-দরজায় মিলি তার হাতটা আঁকড়ে ধরে মোলায়েম স্বরে বলে, “লক্ষ্মীটি, রাগ করছ কেন? আমি কি জানতাম এমনটা হতে চলেছে? পাঁচ দিন আগেও তো অপুটা এসে গেল। আমায় কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত দিল না? আগের কথামত ও-ই তো আমার দশ-বিশ-পঞ্চাশের নোটগুলো পাল্টে এগুলো দিয়ে গেল”।
- ইস্, তোমার ভাইচন্দ্রটি ব্যাঙ্ক-অফিসার বলেই মোদীজীর ‘টপ-সিক্রেট’ সিদ্ধান্তটাও জেনে বসেছিল নাকি? যতসব আদিখ্যেতা!
- জানি, তুমি আমার উপর ভীষণ রেগে আছো। সে থাকো। আমি তোমার বৌ। তাই বলে আমার সাদাসিধে ভাইটাকেও ...
- আরে না, না। তোমার উপর রেগে থাকব? আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সেদিন কত করে বললাম, দু’মাস আগের দিল্লী ট্যুরের টিএ বিলটা আটকে আছে; তোমার জমানো টাকা থেকে এখন কিছু দাও, আমার একটা জরুরী দরকার মিটিয়ে নিই। বিলটা পেলেই ফিরিয়ে দেব। জবাবে কি বলেছিলে তখন? মনে আছে?
- আমার বাপু অতশত মনেই থাকে না; চিরকালই একটু ভুলো-মনা!
- আহারে, চিরকালের ভুলো-মনা বৌ আমার! আমাকে ভাওতা দিয়ে এখন ন্যাকামি হচ্ছে।
- কি বললে? ভাওতা দিয়েছি? আমি? তোমাকে?
- নয়তো কি? এতগুলো টাকা নিজে সরিয়ে রেখে আমার দরকারের সময় আমাকেই হাইকোর্ট দেখিয়েছ। আমাকে পটাতে কি অসাধারণ অভিনয়টাই-না করলে সেদিন-“আহারে, তাই বুঝি? ইস্! এই তো সেদিন যে ছোটকে সাথে নিয়ে জুয়েলারি থেকে আমার পুরনো হারটা ভাঙিয়ে নতুনটা আনলাম, তখনই তো জমানো টাকাক’টা একেবারে সাফ! তবে আমি বেশ জানি গো, তুমি ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবে”। বাধ্য হয়ে টাকাটা আমাকে অন্যভাবে জোগাড় করতে হয়েছিল। কিভাবে সে শুধু আমিই জানি, বুঝেছ?
আসলে ট্যুরে থাকায় পে-কমিশনের এরিয়ারটা সময়মত ড্র করতে পারেনি সুমন। পরে, আজ থেকে দেড় মাস আগে, এক বিকেলে সেটা নিয়ে বাড়িতে আসে। টাকাটা মিলির হাতে দিয়েই দুটি খেয়ে দিল্লীর ‘বস্’কে রিসিভ করতে তড়িঘড়ি এয়ারপোর্টে চলে যায়। সন্ধ্যেবেলা বাড়ী ফিরতেই মিলি তার আবদার নিয়ে হাজির। দশহাজার টাকা চাই। নিজের বহু পুরনো হারটা পাল্টে নতুন ডিজাইন নেবে। একদিকে বড় অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি, তদুপরি গাড়ীতে ‘বস্’-এর মুখে নিজের কাজের প্রশংসা সব মিলিয়ে সুমন সেদিন উড়ছিল। বৌয়ের আবদার পুরোটাই সাথে সাথে মিটিয়ে দিল সে। শুধু বলেছিল, “আমাকে জুয়েলারিতে যেতে বলো না যেন; আই-এস-এল শুরু হয়ে গেছে; আজ এটিকের প্রথম ম্যাচটা দেখতেই হবে”। মিলি বলেছিল, “তাহলে তো হয়েই গেল, গতবারের মতোই ‘মিস্টার দত্তগুপ্তের এটিকে-ফোবিয়া’ আমার সিরিয়াল গুলোর বারোটা বাজাবে। এবার ও যেন ‘রিপিট টেলিকাস্ট টা দেখে নিও’ জাতীয় মলম লাগাতে এসো না। যাক্গে, তোমার ‘এটিকে-প্রীতি’-তে বাধা হব না। আমার ছোট জা-কে বললে সে খুশী মনেই সঙ্গে যাবে; সেদিন বলছিল ওরও কি একটা কেনার আছে”।
সুমন টাকাটা দিয়েছিল বটে, কিন্তু এ নিয়ে আর কোন কৌতূহল দেখায়নি। তার স্বভাবই এমনটি। দায়িত্ব পালন করে যাবে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ততটা জড়িয়ে ফেলবে না। মিলি সেটা জানে। তাই মাঝে মধ্যে টুকটাক কিছু কথার মারপ্যাঁচ ছাড়া তেমন কোন দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে নেই। এ ব্যাপারে সপ্তাহান্তে সুমন শুধু জানতে চেয়েছিল কাজটা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। মিলির সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল “হ্যাঁ”। মিলি কিন্তু নতুন হারটা দেখায়নি। অবশ্যি সুমনও দেখতে চায়নি।
বাকি এরিয়ার টুকু সুমন ইন্ভেস্ট করেছিল। সামনেই টিএ বিলটা পাচ্ছে বলে কোন সমস্যা হবে ভাবেও নি। কিন্তু তখনই কিছু সহকর্মীর সাথে পুরনো একটা হিসেব মেটাতে হঠাৎ তার কিছু টাকার দরকার পড়ে যায়। এদিকে টিএ বিলটা নিয়েও ঝামেলা বাধে। কি হবে এবার? মিলিকে বলবে? সুমন জানত মিলির কাছে সবসময়ই জমানো কিছু টাকা থাকে। সংসার খরচ থেকে কিছু সরিয়ে গোপন সঞ্চয়ের এই দুষ্টু-মিষ্টি ব্যাপারটা তার বেশ ভালোই লাগত। “বিয়ের বছর দুয়েক পর সে’বার টুকাইয়ের দুধ নিয়ে ...”। হঠাৎ পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিতে ডুবে যায় সুমন।
সুমন তখন সপরিবারে ত্রিপুরায়। মাসছয় আগে মিলির কোলে টুকাই এসেছে। কিছুদিন আগে ডাক্তারবাবু ‘ল্যাক্টোজেন’ ছাড়িয়ে টুকাইকে ‘সেরেল্যাক’ ধরিয়েছেন। সেইসময় হঠাৎই বাজারে বেবীফুডের ভীষণ ঘাটতি দেখা দেয়। সব বাবাদেরই কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ! বাচ্চার দুধ কোথায় মিলবে! পাড়ার একটা ছেলে প্রায় দ্বিগুণ দামে পাঁচ কৌটো ‘সেরেল্যাক’ সুমনকে দেবে বলেছিল। কিন্তু সুমনের হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না। এদিকে ক্যাশ না পেলেই নয়। সেইসময় অপ্রত্যাশিত ভাবেই ত্রাতার ভূমিকায় ‘হাউস-ওয়াইফ মিলি’-র আবির্ভাব। দশ টাকার কড়কড়ে নোটগুলি আলমারির লকার থেকে বের করে সুমনের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল লাগলে আরও নিতে। সুমনের তখন টাকার সোর্স নিয়ে গবেষণার সময় নেই। ছেলের জীবন নিয়ে কথা! প্রয়োজনীয় টাকাটা রেখে কৃতজ্ঞতার সাথে বাকিটা মিলিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে। যদিও এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সেই টুকাই আজ নামকরা এমএনসি-তে প্রোজেক্টের কাজ নিয়ে বিদেশে। আর সেই তারুণ্যোচ্ছল, সরলতার প্রতিমূর্তি মিলি এখন ভীষণ রকমের সমঝদার গৃহিনী।
এতবছর পর আজকে সুমনরা যথেষ্ট স্বচ্ছল। তবুও সেদিন ব্যতিক্রমী আর্থিক বিপাকেই পড়ে গিয়েছিল সে। ছিল সহকর্মীদের কাছে মান-সম্মান রক্ষার প্রশ্ন! নিরুপায় হয়েই মিলির কাছে সাহায্য, মানে ধার চেয়েছিল সে। মিলি তার অর্ধাঙ্গিনী। দু’জনের সমস্যা তো আলাদা নয়। এমন পরিস্থিতিতে মিলিকে সে এতটুকু পাশে চাইতেই পারে। কিন্তু মিলি? সুমনের সমস্যাটাকে কোন আমলই দেয় নি! তখন কি সন্দেহ করেছিল কে জানে?
হারটা পাল্টাতে গিয়ে মিলির সব জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে শুনে সুমন শুধু ঠাণ্ডা মাথায় মিলিকে বলেছিল, “সেই টাকাটা তো আমিই তোমাকে দিলাম। যা চেয়েছিলে পুরোটাই। ঠিক কিনা?”
মিলি সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছিল, “ওমা, তুমি কি মিথ্যে বলবে নাকি? কিন্তু তুমি যত দিয়েছিলে তাতে আর হল কই? সোনার দাম যা বেড়েছে! আর মজুরীতো আরো জোরে দৌঁড়ুচ্ছে। ভাগ্যিস আমি নিজের জমানো টাকাগুলো সঙ্গে রেখেছিলাম, তাই তো দোকানে লজ্জায় পড়তে হয় নি”। মিলি ঠিক জানত ওর ভাল বরটি এমনিতে যত মেধাবী আর করিৎকর্মাই হোক, মেয়েদের শাড়ী-গয়নার ব্যাপারে একেবারেই ক্যাবলাকান্ত গোবেচারা।
বৌয়ের সেদিনের কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নি। তবু ঝামেলা এড়াতে সুমন মেনেই নিয়েছিল। আজ মিলির হাতে নোটগুলি দেখে সত্যিই তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সিরিয়াল সংলাপের মতো মিলির মুখনি: সৃত শব্দবন্ধগুলি পরপর স্মৃতিতে জেগে উঠলে সুমন তার মিসিং-লিংক গুলো খুঁজতে চেষ্টা করল। ঠিক তক্ষুনি মিলির ঝাঁকুনিতে আবার হুশে ফিরল সে।
- কিগো, এত ভাবছটা কি? নোটগুলো ধরো এবার। আমার জন্যে কিন্তু একশ নয়, নতুন দু’হাজারের নোট আনতে হবে।
- সোজাসাপটা বলছি, আমি এতে নেই, ব্যস। চাইলে নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে যতটা পার পাল্টে আনো। একজনকে দিনে চার হাজার অব্ধি দেবে, তাও ব্যাঙ্কে যথেষ্ট স্টক থাকলে, তবেই। তোমাকে আরো ক’দিন অনেকবার লাইনে দাঁড়াতে হবে।
সুমন মনে মনে বলে, “এবার মিথ্যে বলার ঠ্যালাটা বোঝ বাপু। কাল নিজের একাউন্ট থেকে দশ হাজার টাকা তুলতে গিয়েই বুঝেছি কত ধানে কত চাউল। ” বাইরে কিন্তু বৌকে শান্তভাবে গাইড করে, “তোমার ভোটার আই-কার্ডটা জেরক্স করিয়ে নিও, দরকার পড়বে। আর শোন, ব্যাঙ্কের শালাবাবুটিকে ফোনে ডিষ্টার্ব করো না যেন। শেষকালে দিদির কালোটাকা সাদা করতে যেয়ে মোদী জীর অভূতপূর্ব অভিযানে তোমার দিদি-গত প্রাণ ভাইটির ভবিষ্যৎ যেন মার না খায়।”