বাংলার গর্ব – আলিপুরদুয়ারের টোটো মেয়েদের ত্রাতা ভূষিত হচ্ছেন জাতীয় শিক্ষক পুরস্কারে

জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত টোটো গ্রামে পৌঁছনো, তারপর রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার গ্রহণের জন্য মনোনীত হওয়া – মিশা ঘোষালের জীবন যেন এক রূপকথা। আলিপুরদুয়ারের টোটো এবং অন্যান্য তপশিলি উপজাতির কয়েকশো মেয়ের পরিত্রাতা হয়ে উঠেছেন তিনি। এদের লেখাপড়া করার সাহস এবং অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। উদ্ভাসিত করছেন শিক্ষার আলোয়। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে এক ছোট্ট উপজাতি টোটো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা শিক্ষার আলো পাননি। বাল্যবিবাহ, মধ্যযুগীয় নানা প্রথা, সাধারণ রোগগুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা তাঁদের জনসংখ্যা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করে চলেছে। মিশা বলেন, “উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তে থাকা দরিদ্র উপজাতিগুলিকে সর্বদাই আমি সাহায্য করতে আগ্রহ বোধ করি। জলপাইগুড়িতে বেড়ে ওঠার কারণে নিজের চোখে এইসব উপজাতিদের দেখেছি। অনুভব করেছি যে একমাত্র শিক্ষার আলোই এঁদের জীবনযাত্রার কঠোরতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।”
ধনীরাম টোটো উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়
মিশা নিজে কার থেকে অনুপ্রেরণা পেলেন? তাঁর কথা, “আমার মা ছিলেন নারীশিক্ষার বড়ো সমর্থক। আমাকে সর্বদা পড়তে উৎসাহিত করতেন। তিনিই আমার অনুপ্রেরণা। ছোটো শহর থেকে আসা সত্ত্বেও তিনি আমাকে বাইরের জগতে পা রাখতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহস জোগাতেন”। মায়ের প্রেরণাতেই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে তাক লাগানো ফলাফল করেন মিশা ঘোষাল। কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াশোনা করেন। কিন্তু নিজের শিকড়কে ভোলেননি। আলিপুরদুয়ারে ফিরে অনগ্রসর উপজাতিগুলির উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
এখানে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করে মিশা ঘোষাল মেয়েদের জীবন পাল্টাতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন
রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেই সুযোগ তাঁর হাতের মুঠোয় চলে এল। আলিপুরদুয়ারের একটি স্কুলে নিয়োগ করা হল তাঁকে। জায়গাটায় টোটো এবং অন্যান্য দরিদ্র উপজাতির বাস, যাঁরা আশেপাশের চা বাগানে কাজ করেন এবং অনেকেই মদ্যপান ও চোরাপাচারের সঙ্গে যুক্ত। নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। ২০০৮ সালে মিশা যোগ দেন ধনীরাম টোটো উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে।
আরও পড়ুন: আমফান বিধ্বস্ত ‘কাকিমার পাঠশালা’য় পৌঁছালাম
সেখানে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করে তিনি মেয়েদের জীবন পাল্টাতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের স্কুলছাত্রী। মিশা জানান, “আমি যোগ দেওয়ার আগে খুব কম ছাত্রীই মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হত এবং পড়াশোনা চালু রাখত। এখন পাশের শতাংশ বহুলাংশে বেড়ে গিয়েছে। অভিভাবকদের আমি বোঝাতে পেরেছি যে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া বিয়ের থেকে বেশি জরুরি”।
এই স্কুলের ৯৯ শতাংশ মেয়ে অনগ্রসর উপজাতির সদস্য এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই টোটো
মায়েরা যখন স্বেচ্ছায় মেয়েদের পড়ানোর জন্য স্কুলে নিয়ে আসেন এবং পড়াশোনায় সাহায্য করতে মিশাকে অনুরোধ করেন, তিনি এক নির্মল আনন্দের স্বাদ পান। এই স্কুলে রীতা টোটো নামে এক ছাত্রী ছিল, মিশা যোগ দেওয়ার আগেই স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে পড়াশোনা শিখে এখন সরকারি কাজে ব্রতী। তার কথা মিশার প্রায়ই মনে পড়ে। এই স্কুলের ৯৯ শতাংশ মেয়ে অনগ্রসর উপজাতির সদস্য এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই টোটো। স্কুলের আশ্রম হোস্টেল নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য মিশা ধন্যবাদ জানান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ ও উপজাতি উন্নয়ন বিভাগকে। গ্রাম থেকে দুর্গম পথ অতিক্রম করে স্কুলে আসার কষ্ট থেকে ছাত্রীরা মুক্তি পেয়েছে। “বর্ষার সময় পাহাড়ি রাস্তা চলাচলের উপযুক্ত থাকে না। তখন অনেক ছাত্রী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিত। হোস্টেল চালু হওয়ার পর সেই সমস্যা মিটেছে। ছাত্রীরা এখানে থেকে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করে” – জানান মিশা।
মিশা ঘোষালের কঠোর পরিশ্রম টোটোদের জীবনে এক যুগান্তকারী বদল এনেছে
আদিবাসী মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে এবং আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করতে মিশা ঘোষাল যে কঠোর পরিশ্রম করছেন, তা টোটোদের জীবনে এক যুগান্তকারী বদল এনেছে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার থেকে তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন। শিক্ষক দিবসে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের থেকে মিশা জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার লাভ করছেন, তা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয়।
(সাক্ষাৎকার সৌজন্যে –টেলস টকস ওয়াকস)