মুঘল সম্রাটের মুনশি ও প্রথম বাঙালি ইউরোপ যাত্রীর ডায়রি

মুনশিদের মুনশিয়ানা এদেশের ইতিহাসে বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কেরি সাহেবের মুনশি, রবার্ট ক্লাইভের মুনশির কথা আমরা জানি। তাদের ভূমিকা ইতিহাসের বাঁকবদলকে কতটা প্রভাবিত করেছে – তাও সুবিদিত। এঁদেরই প্রায় সমসাময়িক আরেকজন মুনশির নাম মির্জা শেখ ইতেসামউদ্দিন। শুধু মুনশিয়ানার কৃতিত্বে তিনি কীর্তিমান নন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি ইউরোপ গিয়েছিলেন। আর শুধু যাননি, ফিরে এসে লিখেছিলেন ইউরোপের সফরনামা। অষ্টাদশ শতকে একজন বাঙালির চোখ দিয়ে ইউরোপকে দেখা, বিশেষ করে ইংল্যান্ডকে দেখা – আজও রোমাঞ্চিত করে।
মির্জা শেখ ইতেসামউদ্দিন জন্মেছিলেন নদিয়া জেলার চাকদহতে আনুমানিক ১৭৩০ সালে। তাঁর বড়ো ভাই গুলাম মোহিউদ্দিন ছিলেন নবাব আলিবর্দির মুফতি। ইতেশামউদ্দিন তাঁর জীবিকা শুরু করেছিলেন মিরজাফরের দরবারে সহকারী হিসেবে। অচিরেই পদোন্নতি হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগদান করেন ১৭৬২ সালে। ফারসিতে চিঠিপত্র লেখা কাজ ছিল তাঁর। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের সময় সশরীরে উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
তারপর ১৭৬৫ সালে তিনি নিযুক্ত হন মুঘল বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের দরবারে। ১৭৬৫ সালে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজস্বের অধিকার পেয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার ফারসি বয়ানও লিখেছিলেন ইতেসামউদ্দিন। বিলেত যাওয়ার বরাত পান তার পরের বছর ১৭৬৬ সালে।
ব্যাপারটা হয়েছিল এই, এলাহাবাদবাসী মুঘল সম্রাট তখন দিল্লিতে ফিরতে আকুল। ক্লাইভকে পত্র লেখেন, দিল্লিতে ফেরার ব্যবস্থা করতে বলেন। ক্লাইভ চিরকাল বুদ্ধিমান। বলেন, কোম্পানির সৈন্যসামন্তকে তিনি সম্রাটের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে নাকাম। একাজ করতে পারেন একমাত্র ইংল্যান্ডের মহারাজা। শাহ আলম তাতেও রাজি। যেভাবেই হোক তিনি ইংল্যান্ডের মহারাজার সঙ্গে দেখা করবেন। ক্লাইভ জানালেন, তিনি আপাতত দেশে ফিরছেন না। ফিরছেন কোম্পানির ক্যাপ্টেন আর্চিবাল্ড সুইন্টন। মুঘল সম্রাট তাঁর হাত দিয়েই আবেদনপত্র পাঠাতে চাইলেন। চিঠির সঙ্গে দিলেন অমূল্য সব নজরানা। সঙ্গে এক লক্ষ টাকা। আর্চিবাল্ডের সঙ্গে যাওয়া স্থির হল ইতেসামউদ্দিনের। সম্রাটের ব্যক্তিগত দূত হিসেবে তিনি যাত্রা করবেন। তাঁর ব্যয়ভার বহন করবে মুঘল পরিবার। আর ব্যক্তিগত খরচের জন্যে তাঁকে দেওয়া হল পাঁচ হাজার টাকা।
যাওয়ার দিন সমাগত। ১৭৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব মেদিনীপুরের হিজলি বন্দর থেকে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। শীত, কুয়াশায় পরিস্থিতি প্রথমেই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে। জাহাজ ছাড়ার পর শোনা যায়, ক্লাইভ আর্চিবাল্ডকে না দিয়েছেন চিঠি, না কোনো উপঢৌকন। কিন্তু কী করবেন ইতেসামউদ্দিন? মাঝদরিয়ায় তো আর ঝাঁপ দিয়ে পড়া যায় না, ‘স্টিমার দিয়েছে দিগন্তে পাড়ি...’ – পারের ভাবনা পারেই রেখে ইতেসামও পাড়ি জমালেন। প্রথম বাঙালির ইউরোপযাত্রা এভাবেই।
তবে ইতেসামউদ্দিনের আগে কোনো বাঙালি যাননি – একথা টেবিল চাপড়ে বলা কঠিন। হতেই পারে কেউ গিয়েছেন, কিন্তু লিখিতপড়িতভাবে তাঁর যাওয়াটাই স্বীকৃত।
জাহাজে চলার সময় মন দিয়ে দেখেছিলেন ইংরেজদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। দিক নির্ণয়ের কম্পাস, হাওয়া বুঝে পাল খাটানোর নানা বন্দোবস্ত – বোঝার চেষ্টা করলেন এই বিশ্বজয়ী জাতিটির জয়ের গোপন অস্ত্রগুলো কী কী। প্রযুক্তিকে যে ভালোভাবেই তারা রপ্ত করেছে, তা ইতেসামের বুঝতে বাকি রইল না। ইউরোপ পৌঁছানোর আগে নেমেছিলেন কেপটাউনে। প্রচুর কেনাকাটা করেছিলেন নাকি বন্দর থেকে। ফরাসি বন্দর নন্তে নেমেই বুঝে নিয়েছিলেন ইংরেজ ও ফরাসিদের চিরকালীন বিবাদের কাহন। আর ইংল্যান্ডে গিয়ে বুঝেছিলেন, কীভাবে বন্দর থেকেই গোপনে বিদেশি পণ্য পাচার হয়ে চলে যায় দেশের অভ্যন্তরে। বাঘা মুনশি বটে ইতেসাম। কিছুই তার নজর এড়ায় না।
পোশাকের জন্যে প্রথম প্রথম ব্রিটিশরা তাঁকে একটু দূরেই সরিয়ে রাখত বটে। পরে সেই দূরত্ব কেটে যায়। অনেক বিদেশিনী নাকি চুম্বনপ্রত্যাশীও ছিলেন ইতেসামউদ্দিনের (সুপুরুষ ছিলেন বুঝি খুব!)! নিজেই লিখে গিয়েছেন সেই ঘটনার কথা।
অক্সফোর্ডে গিয়েছিলেন ইতেসামউদ্দিন। হাজার বছরের পুরোনো মাদ্রাসা দেখে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর। উইলিয়াম জোন্সের সঙ্গে সেখানে আলাপ হয়। তাঁকে বাগে পেয়ে উইলিয়াম জোন্স কয়েকটি ফারসি গ্রন্থের পাঠোদ্ধার করিয়ে নিয়েছিলেন। ‘কালিলে ওয়া দেমনে’ – আরবি ভাষায় লেখা পঞ্চতন্ত্র তাঁর কাছ থেকে বুঝে নিয়েছিলেন ডক্টর হান্টার। ফরহাদ জাহাঙ্গিরি নামে ফারসি ব্যাকরণের নিয়মও নাকি ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলেন তিনি। এর পরপর আমাদের দেশে জোন্স সাহেব এসে যে মহান কীর্তিটি করেছিলেন, তার একটা সেতু আমরা বলতেই পারি ইতেসামউদ্দিনকে। অতিশয়োক্তি হবে কি?
খুঁটিয়ে দেখেছিলেন ইংরেজদের সমাজব্যবস্থাকে। দেখেছিলেন, নারীরা অনেক বেশি মুক্ত। পথচলায়, পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশায় তাদের এদেশের মতো কোনো আগল নেই। দেখেছিলেন, সে দেশের শিল্পী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, কবি সাহিত্যিকরা কী পরিমাণ শ্রদ্ধা পান। তাদের কাজকর্ম দেখতে লোকে টিকিট কেটে থিয়েটারে যায়। দেখেছিলেন অত্যন্ত কড়া বজ্র-আঁটুনি আইনকানুন ইংল্যান্ডে। ক্ষমার কোনো স্থানই নেই। কিন্তু তারপরেও ইংল্যান্ড দেশটা চোর ছিনতাইবাজ খেপমারে ভরতি।
আড়াইশো বছর আগে ইংল্যান্ডে গিয়ে তার হালহকিকতের নিরপেক্ষ বিচার করছেন ইতেসামউদ্দিন। পরবর্তীকালে এদেশের বহু মানুষই সেখানে গিয়েছেন। মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় তেমন পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি। যেদিন নিজের রুচি-ধর্ম-অনুসারী খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সেদেশে চলতে পারলেন না, সেদিনই বিদায় জানালেন ইংল্যান্ডকে।
তাঁর লেখায় যেভাবে ইংল্যান্ডের নতুন বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত ভাবাদর্শের নিপুণ পর্যবেক্ষণ লক্ষ করা যায়- তা বাস্তবিকই বিরল। ইংল্যান্ডের স্কুল কলেজ, সামাজিক রীতিনীত, রাজা ও তার ক্ষমতাশালী সরকার – এইসমস্ত প্রসঙ্গের নিখুঁত ছবি মেলে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার তুলনামূলক বিচারও করেছেন ইতেসাম। ভালোমন্দের সুচারু জ্ঞান যে তাঁর ছিল – সেই প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশে ঔপনিবেশিক শাসন পরিপূর্ণ কায়েম হওয়ার আগে এই ভ্রমণ নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপকে ঘিরে বাঙালির আকর্ষণ, কৌতূহল, মুগ্ধতার শেষ নেই। তবে এমন নিরপেক্ষ তুলনামূলক আলোচনা কজনই আর করতে পেরেছে! সেদিক থেকে আমাদের নদিয়ার মুনশি আলাদা কৃতিত্বেরই দাবিদার বটে!
ঋণ : ‘বাঙালির প্রথম ইউরোপ চর্চা’- পার্থ চট্টোপাধ্যায়।