মাহেশের 'অলৌকিক' জগন্নাথ

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, ১৮৭২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি নতুন পত্রিকা শুরু করেন। বাঙালির সাহিত্য এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তায় আসে যুগান্তর। কিংবদন্তি সেই পত্রিকার নাম 'বঙ্গদর্শন'। ১৮৭৫ সালের শরতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন 'রাধারানি' উপন্যাস, খানিকটা সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। রথযাত্রার মেলায় এক কিশোরি হারিয়ে গিয়েছিল, তা নিয়েই কাহিনী। উপন্যাসের শুরুতেই মেলার জমকালো বিবরণ পাওয়া যায়।
'রাধারানি' উপন্যাসে যে রথের মেলার বিবরণ রয়েছে, তা হলো মাহেশের মেলা। হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রার আয়োজন হয় মাহেশে। সে এক বিরাট উৎসব। যাঁরা দেখেননি, তাঁদের কেবল বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এবার সেই রথযাত্রা ৬২৫ বছরে পা দিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত বছর এবং এবছরও অনুষ্ঠান কমিয়ে ফেলতে হয়েছে অনেকটা। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি বিপর্যয় কেটে যাবে। আগের মতো সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠতে পারব আবার।
জগন্নাথকে মনে করা হয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার। ভক্তদের বিশ্বাস, বর্ষাকালে তিনি যান 'সখী' পৌর্ণমাসীর বাড়ি। সঙ্গে যান বলরাম এবং সুভদ্রা — জগন্নাথের ভাইবোন৷ রথযাত্রা হিন্দুদের এক প্রধান উৎসব। তবে কালক্রমে বাঙালিদের কাছে পৌর্ণমাসী হয়ে উঠেছেন স্রেফ 'মাসি' — মায়ের বোন৷ আমাদের রাজ্যে অনেকেই তাই ভুলবশত ভাবেন, রথযাত্রায় ভগবান জগন্নাথ পাড়ি দেন মাসির বাড়ি।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েত তমালকৃষ্ণ অধিকারী জানালেন, এবছর সাময়িকভাবে মাসির বাড়ি স্থাপন করা হবে মন্দিরের কাছেই। সেখানে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা থাকবেন উল্টোরথের দিন, অর্থাৎ ২০ জুলাই পর্যন্ত। রথযাত্রা এবার ১২ জুলাই তারিখে। তবে জগন্নাথ রথে চাপবেন না এবার। পদব্রজে শোভাযাত্রা করে তিন দেবদেবীর প্রতিনিধি হিসেবে ভগবান নারায়ণকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে মূল মাসির বাড়িতে। উল্টোরথের দিন মন্দিরে ফেরত আনা হবে। তমালবাবু বললেন, "যাত্রার শুরুতে আমরা রথের চারদিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করব। কিন্তু রথ চলবে না।"
প্রাচীনত্ব এবং জনসমাগমের দিক থেকে পুরীর পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হয় মাহেশে। প্রত্যেক বছর দু'লাখেরও বেশি মানুষ জমা হন উৎসব এবং মেলায়। পুরীর সঙ্গে তুলনা আসবেই, তা সত্ত্বেও মাহেশ নানা দিক থেকে অনন্য। এখানকার রথের উচ্চতা ৫০ ফুট, পুরীর চেয়েও বেশি। তমালবাবু জানান, "আমাদের রথ পৃথিবীর বৃহত্তম। পুরীতে প্রভু জগন্নাথের রথের উচ্চতা ৪৫ ফুট, বলভদ্রের রথ ৪৩ ফুট, মা সুভদ্রার রথ ৪২ ফুট। আমাদের রথের ওজন ১২৫ টন (প্রায় ১১৪ হাজার কেজি)৷ বিশাল ম্যানিলা দড়ি দিয়ে টানা হয়। চারতলা রথের ১২টি চাকা ১২ মাসের প্রতীক৷ জগন্নাথের চোখের প্রতিনিধি স্বরূপ রথের গায়ে ৯৬ জোড়া চোখ আঁকা"।
পার্থক্য এখানেই শেষ নয়। মাহেশের এখনকার রথ "মাত্র ১৩৯ বছরের পুরোনো", বললেন তমালবাবু। কারণটাও অদ্ভুত। বহু লোক বিশ্বাস করেন, রথে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারলে সোজা চলে যাবেন স্বর্গে। আগেকার দিনে অনেকে তাই রথের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতেন। অনেকে রথের চাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মবলি দিতেন। "মৃত্যুর ফলে কাঠের তৈরি রথ অপবিত্র হয়ে যেত, কাজেই প্রায়ই নতুন রথ বানাতে হত", জানালেন তমালবাবু।
মন্দিরে এখনকার রথটি দান করেন জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র বসু। তিনি থাকতেন কলকাতার শ্যামবাজারে। এই রথ ছিল লোহার, যা কিনা অশুচি হলেও শুদ্ধ করে নেওয়ার বিধান রয়েছে। লোহার ওপর কাঠের প্রলেপ দেওয়া এই রথ তৈরি করেছিল বিখ্যাত মার্টিন বার্ন কোম্পানি। খরচ হয় তখনকার দিনে প্রায় ২০ হাজার টাকা। সামনের বিশাল দুটি তামার ঘোড়া বানিয়ে দেয় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। বর্তমানে রথটির আর্থিক মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
কোভিডের প্রকোপে রথযাত্রা সাময়িক বন্ধ ঠিকই, তবে মাহেশে গিয়ে রথের অসাধারণ নান্দনিক গড়ন আপনি নিজের চোখে দেখতে পারেন। মাহেশ কলকাতার খুব কাছেই। একদিনে গিয়ে রথ দেখে ফেরা যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, জগন্নাথদেব কোথাও চলে যাচ্ছেন না৷ তমালবাবু বলেন, ৬২৫ বছরের পুরোনো কাঠের মূর্তিতে জীর্ণতার কোনো চিহ্ন নেই। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরও ভারী হচ্ছে। এটা কি অলৌকিকতা নয়?