No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলা সংশোধনে রামনারায়ণ তর্করত্নের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মধুসূদন 

    বাংলা সংশোধনে রামনারায়ণ তর্করত্নের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মধুসূদন 

    Story image

    এও কি সম্ভব! মেঘনাদবধের কবি নাকি বাংলা লেখা সংশোধন করতে দিচ্ছেন রামনারায়ণ তর্করত্নকে! বাংলায় তাঁর আত্মবিশ্বাসের এত অভাব! অথচ তিনিই কিনা, বাংলার প্রথম সনেট-রচয়িতা, প্রহসন, পত্রকাব্যের জন্মদাতা, ট্র্যাাজেডি- সেও তাঁর হাত ধরে। তা এ হেন মহাকবির বাংলাতেই এমন করুণ অবস্থা। শোনা যায়, একদা নাকি তিনি তর্ক করেছিলেন, ‘পৃথিবী’ বানান আসলে ‘প্রিথিবী’। সত্যিই অবাক-করা ব্যাপার! তবে, একথা সর্বৈব সত্য। বাংলা লেখা নিয়ে মধুসূদনের খানিক সমস্যাই ছিল। 

    মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরেছেন যখন, তখন মধুসূদন (খানিক স্বভাববশতই) কপর্দকশূন্য। অনেক কষ্টে, বন্ধুদের সাহায্যে ১২৫ টাকা বেতনের একটি চাকরি জুটিয়েছেন। ইতিমধ্যে কলকাতায় নাট্যচর্চার সুরুয়াত হয়েছে। প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেলগাছিয়া নাট্যশালা। ১৮৫৮-এর জুলাই মাসে সেখানে ‘রত্নাবলি’ নাটকের অভিনয় হয়। তাঁরা ঠিক করেন, সেই নাটকের তৃতীয় অভিনয়ে বাংলার গভর্নর ফ্রেডারিক হ্যালিডেকে আমন্ত্রণ জানাবেন। সঙ্গে থাকবেন অন্যান্য সাহেব কর্মকর্তা ও অবাঙালি বেশকিছু দর্শক। এবার ‘রত্নাবলি’র সংলাপ  তো তাঁরা বুঝবেন না। তাই ঠিক হয়, এই নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে৷ কে আছেন এমন সুদক্ষ ইংরেজি অনুবাদক? গৌরদাস বসাক মধুসূদনের নাম প্রস্তাব করেন। মধুসূদনের ইংরেজি-পাণ্ডিত্য নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না ঠিকই। কিন্তু বাংলা নিয়ে ছিল। নাটকটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে লোকজন খানিক খটকাও প্রকাশ করেন। সেটা কানেও যায় মধুসূদনের। আর কী! জেদ চেপে বসে মাথায়। অসামান্য এক অনুবাদ নামিয়ে ফেলেন তিনি। দেশি-বিদেশি যাঁরাই সেদিন তাঁর অনুবাদ দেখেছিল – নির্দ্বিধায় উচ্চকিত  প্রশংসা করেছিল। পাঁচশো টাকা পারিশ্রমিক লাভ করেছিলেন মধুসূদন। অবশ্য, রামনারায়ণের রচনা নিয়ে বলেছিলেন, তার মানই নাকি অত্যন্ত খারাপ। 

    এরপর মধুসূদন হাত দেন বাংলা নাটক রচনায়। তিনি বাংলা তেমন জানেন না, এই ধারণাকে দুরমুশ করতে চেয়ে, একপ্রকার জেদের বশেই বাংলা লিখতে তিনি শুরু করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে গিয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বেশকিছু বইপত্র নিয়ে আসেন, পড়াশোনা শুরু করেন। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বন্ধু গৌরদাস বসাককে পড়ে শোনান ‘শর্মিষ্ঠা’র প্রথম দৃশ্য। স্বাভাবিকভাবেই গৌরদাস উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন বন্ধুর এই কীর্তিতে। যদিও মধুসূদন তখন তাঁর এই রচনার কথা গোপন রাখতেই বলেছিলেন, কিন্তু গৌরদাস তা পারেননি। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কাছে প্রিয় বন্ধুর অসামান্য কীর্তির কথা তিনি বলে ফেলেন। যতীন্দ্রমোহনও আনন্দিত, রোজই পাণ্ডুলিপির তাগাদা পাঠান। মধুসূদন তখন কিন্তু সমস্যায় পড়েন। বাংলা নিয়ে তাঁর যে আত্মবিশ্বাসের বেশ অভাবই ছিল, তা স্পষ্ট হয়। পাণ্ডুলিপি তিনি পাঠাতে থাকেন রামনারায়ণ তর্করত্নকে। কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলে তিনি শুধরে দেবেন, এই আশায়। কিন্তু আশাহত হতে বেশি সময় লাগে না। সংস্কৃত-পণ্ডিত রামনারায়ণ অমন পশ্চিমি ছাঁচের নাটক ঠিক আত্মস্থ করতে পারেননি। মধুসূদনের অনেক বাক্য তিনি নিজের মতো করে লিখে দেন। তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন মধুসূদন। বন্ধুকে জানান, ‘আমার বেচারি শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে রামনারায়ণ জঘন্য গদ্যে কথা বলিয়েছেন...’। এরপর ঠিক করেন, যা লিখবেন নিজেই লিখবেন। অন্যকারো সহায়তা নেবেন না। অবশ্য মধুসূদন রামনারায়ণের বেশকিছু মতামত মেনে নিয়েছিলেন। এরপর  ‘শর্মিষ্ঠা’র প্রকাশ বাংলা সাহিত্য নতুন এক দিগন্তকে দেখতে শিখেছিল- তা তো বলা বাহুল্যই।      

    তবে, একথা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়, বাংলাভাষায় ইতিহাস তৈরি করলেন যিনি, তিনি নিজেই এতটা সংকটে ভুগতেন ভাষাটিকে ঘিরে। কলেজে পড়তে বাংলায় কবিতা কিছু লিখেছিলেন তিনি, যেমন – “গভীর গর্জন সদা করে জলধর / উথলিল নদনদী ধরণী উপর...”।

    সেই কাব্যচর্চা পরে একেবারেই বন্ধ করে দেন। সাগরপারের দেশ অ্যালবিয়নের (ইংল্যান্ড) মোহ তাঁকে ঘিরে ধরে। তারপর গোটা জীবনেই সেই মোহপাশ থেকে তাঁর বেরোনো হল না। ইংরেজি ভাষাসাহিত্য চর্চাই তাঁর একমাত্র মোক্ষ হয়ে উঠল। ছোটোবেলায় মধুসূদন বাংলা পড়েছিলেন রামতনু লাহিড়ীর কাছে। হিন্দু কলেজ বা বিশপ কলেজেও বাংলা চর্চা হত তাঁর। তবু যেন বাংলা তাঁর সরগর হয় না। মাদ্রাজে থাকতে বন্ধু গৌরদাস বসাককে চিঠি লিখে বারবার জানাচ্ছেন, বাংলা তিনি প্রায় ভুলতে বসেছেন। কখনো চেয়ে পাঠাচ্ছেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ। সন্তান জন্মের সুসংবাদ নিজের মাকে তিনি জানাতে পারছেন না, কারণ তিনি নাকি বাংলা ভুলে গিয়েছেন। 

    সন্দেহ জাগে। যেকোনো ভাষাতেই এত গভীর ব্যুৎপত্তি যাঁর, তিনি নিজের মাতৃভাষা এতটা বিস্মৃত হয়েছেন! আর তার কিছু বছর পরেই লিখে ফেলছেন অপূর্ব সব বাংলা সাহিত্য। 
     
    কেমন যেন মনে হয়, মধুসূদনের এই ভুলে যাওয়া ইচ্ছাকৃত। যেন জোর করে ভুলতে চাইছেন মাতৃভাষা। কেন? অবজ্ঞা? না, এত সহজ সে সমীকরণ নয়। মধুসূদন হয়তো টের পেতেন তাঁর মধ্যেকার বাংলাভাষার গভীর শিকড়কে৷ তিনি জানতেন, এই ভাষাটিই হয়তো তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে  বেঁধে ফেলতে পারে। ভিতর থেকে বদলে দিতে পারে। এ সত্য নিশ্চিত মধুসূদন জানতেন। কিন্তু তিনি তো ইংল্যান্ডের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটি। পাছে তাঁর ‘ইংরেজ’ হয়ে ওঠার দুর্লঙ্ঘ সাধনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে দেয় তাঁর মাতৃভাষা। পাছে তাঁর পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়, এই ভাষার ডালপালা? তাহলে তো আকাশকুসুম স্বপ্নটিকে আর কখনোই আত্মস্থ করা যাবে না। তাই হয়তো প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাভাষাকে আপ্রাণ ভোলার চেষ্টা করেছেন। বন্ধুর কাছে লিখেছেন, বাংলা ভুলে গেছেন, আসলে বলেছেন নিজেকেই। মধুসূদন, তাঁর অসম্ভবকে স্পর্শ করার তীব্র নেশা, আশার ছলনে ভোলার অনিবার্য প্রবণতা – আজও আমাদের নির্বাক করে দেয় বইকি। নক্ষত্রের কতরকম মৃত্যুই না হতে পারে, মধুসূদন যেন সে কথাই জানান দিয়ে যান বারবার।


    ঋণ : ‘মাইকেল’ - শিশিরকুমার দাশ
    ‘আশার ছলনে ভুলি’- গোলাম মুরশিদ

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @