প্রিয় মেটকাফ সাহেব আর ইয়াব্বড়ো এক ইমারতের গল্প

স্ট্র্যান্ড রোড ধরে গাড়ি ছুটছে সোঁ সোঁ শব্দে। গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। বাঁ-দিকে চলে গেল আকাশবাণী ভবন, ইডেন গার্ডেনস। তারপরেই গঙ্গাতীরের রাস্তা ধরে সোজা এগোনো। এই রাস্তার ওপরে কতকিছু। দেখে দেখে আশ মেটে না। কলকাতার এই অঞ্চলেই খানকতক পুরোনো গাছপালা তাও আছে। মোটা গুঁড়ি আর ভরপুর পাতার মোট নিয়ে। আর আছে পুরোনো স্থাপত্যের ভিড়। শীতের দুপুরবেলা। রোদ যখন মরতে বসেছে তখন দেখলাম সেই মরা-রোদ থামের মাথায় জড়িয়ে আলো হয়ে আছে মেটকাফ হল। ঠিকানা: ১২নম্বর স্ট্র্যান্ড রোড।
এই বিশাল হলের পশ্চিম দিকে গঙ্গা। স্ট্র্যান্ড রোড যেখানে মিলছে হেয়ার স্ট্রিটের সঙ্গে, ঠিক তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এই হল। সারি সারি থাম দিয়ে ঘেরা হলের অন্দর। থামের সংখ্যা ৩০। আর সেগুলি উচ্চতায় প্রায় ৩৬ ফুট। বেসমেন্ট থেকে থামগুলি সোজা উঠে গেছে একেবারে ছাদে। পশ্চিমদিকে পোর্টিকো বা কলোনয়েড। কেউ কেউ মেটকাফ হলের মধ্যে গ্রিক মন্দিরের আদল খুঁজে পান। এই হলটির সবথেকে বড়ো পাওনাটি হল গঙ্গার হাওয়া। সেসময় গঙ্গার ‘দূষণ’-রোগ শুরু হয়নি। হাওয়ার জোরও ছিল বেশি। তাতে ধুলো-ধোঁয়ার গন্ধ ছিল না। দেহমন চাঙ্গা হয়ে উঠত। আর সেই ‘স্নিগ্ধ সমীর’ লুটোপুটি খেত মেটকাফ হলের আঙিনায়।
মেটকাফ হলের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার মাথায় উড়ে আসতেই পারে অতীত যুগের গল্পগাছা। কল্পনাশক্তি যদি আপনার জবরদস্ত হয়, তাহলে চোখের সামনে থেকে মোটরগাড়িগুলোকে উধাও করে ফেলুন। আর ভাবুন, ল্যান্ডো, ব্যারুস, ব্রুহাম হাঁকিয়ে সাহেব-মেমের দল হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। তখন গঙ্গার ওপর পাঁচিলের সাজ বসেনি। জোয়ার-ভাঁটার খবর মিলত। আমাদের এই পোড়ো-সময়ে গল্পেরা প্রায় থাকেই না। খুচরো খবর হয়ে কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। তাই, অতীত-কাঠামোগুলোর কাছে যাওয়া যেতেই পারে, গল্পের হদিশ নিতে।
স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটকাফ ছিলেন ভারতবর্ষের একবছরের গভর্নর জেনারেল। লর্ড বেন্টিঙ্কের পরে ১৮৩৫-৩৬ পর্যন্ত ছিল তাঁর মেয়াদ। কিন্তু, তার মধ্যে একটি যুগান্তকারী কাজ ভদ্রলোক করেছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি। আমাদের দেশে আজও সংবাদপত্র বা সাংবাদিকরা অনেক সময়েই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। কখনো বা আততায়ীর হাতে খুন হয়ে যেতে হয়। নিখোঁজ হয়ে যেতে হয়। রাজনৈতিক দলকে তোষামোদ করতে হয়। সংবাদপত্রকে কীভাবে চাপে রাখতে হয়, তা ব্রিটিশরাজ খুব ভালোভাবেই শিখিয়েছে।
সে যাই হোক, একবছরের শাসনকর্তা মেটকাফ সংবাদপত্রের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞাগুলি সরিয়ে নিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় প্রথম হাতকড়া পরিয়েছিলেন ওয়েলেসলি। ১৭৯৯-এর ১৩ মে। হেস্টিংসের সময় সেই হাতকড়া লাগু হয়েছিল হিকি ও তাঁর গেজেটের ওপর। হেস্টিংসের কার্টুন নাকি প্রকাশ পেয়েছিল সেখানে। তারপর, ১৮২৩-এ জন অ্যাডাম আরো শক্ত আইন এনেছিলেন সংবাদপত্রকে সবক শেখাতে। বলেছিলেন, লাইসেন্স না থাকলে পত্রিকা প্রকাশ করা যাবে না। তারপর লর্ড বেন্টিঙ্কের আমল। খানিক উদার-উদার হাওয়া বইছে কলকাতায়। ফলে এদেশীয় ও এদেশের ইউরোপীয় কাগজগুলি আন্দোলন করে বসল--সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ চলবে না। মেটকাফ তা মেনে নিলেন। ১৮৩৫-এর ৩-অগাস্ট ঘোষণা করলেন, কোনো পত্রিকাকেই প্রকাশের জন্য অনুমতি নিতে হবে না। তবে হ্যাঁ, ভুলভাল খবর প্রকাশ করলে শাস্তি পেতে হবে।
১৭৮৫তে মেটকাফ জন্মেছিলেন এই কলকাতা শহরেই। ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম ছাত্র, খুব গভীরভাবে শিখেছিলেন ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ। অন্যান্য ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়তো তাঁকে অনেকটাই উদার করেছিল। তাই নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, কোনো দেশের কোনো সরকার বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
এই নির্দেশে তো কলকাতার লোকজন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তাঁকে বলা হল ‘Liberator of Indian Press’। মেটকাফ তাতে আনন্দিত হয়েই কীনা কে জানে, এদেশীয় লোকেদের সঙ্গে মিলে খুলে ফেললেন ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির প্রথম কর্তা ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
মেটকাফের এই অতিরিক্ত লিবার্যাল হওয়াটা ব্রিটিশরা অবশ্যই হজম করেনি। একবছর পরেই তাঁকে সরানো হয়।
তবে, এদেশের মানুষ তাতে দমেনি। তাঁরা মেটক্যাফকে স্বীকৃতি দিতে উঠেপড়ে লাগে। দেশি-বিলিতি বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হয়। আর, ১৮৪০-এ শুরু হয় মেটকাফ হল গড়ার কাজ। অঞ্চলটি ছিল হরিনারায়ণ শেঠের সম্পত্তি। সেটি খরিদ করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর, ড: জেমস গ্রান্ট হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গভর্নর জেনারেলসহ বহু সম্ভ্রান্ত নারীপুরুষ উপস্থিত ছিলেন সেদিন। মেটকাফকে বদলি করলেও তাঁর নামাঙ্কিত হল তৈরিতে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই অনবদ্য স্থাপত্যের কাঠামোটি পরিকল্পনা করেছিলেন সি.কে. রবিনসন।
মেটকাফ হল গড়া শেষ হয় ১৮৪৪-এ। এথেন্সের ‘টেম্পল অব দ্য উইন্ডসের’ আদল নাকি মিশে আছে এর পোর্টিকোয়। উইলিয়াম কেরির তৈরি ‘এগ্রিকালচার এন্ড হর্টিকালচার সোসাইটি’কে তুলে আনা হল মেটকাফ হলের নিচের তলায়। আর পাবলিক লাইব্রেরিকেও ১৮৪৪-এর জুন মাসে নিয়ে আসা হয় এই হলেই। লর্ড কার্জনের আমলে এই হলটি থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরি।
এমনই ‘গল্প’ মেটকাফ ও তাঁর নামাঙ্কিত হলের। গল্প, কারণ এর ইতিহাস নেড়েঘেঁটে দেখার সুযোগ সাধারণের মেলে না। লাইব্রেরি ব্যাপারটিই লুপ্ত হতে বসেছে। আর সংবাদমাধ্যমগুলি এমনই হলুদ-মাখামাখি যে কী তার স্বাধীনতা, তা সে নিজেই জানে না।
তবে হ্যাঁ, ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এই ইমারৎ নিজেই এক মস্ত গল্প তো বটেই। কল্পনা করতে পারলে ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’-এর হদিশ পেতে পারে যে কেউ। আমাদের জন্মান্তর নেই, কিন্তু জাতিস্মর-সত্তা আছে। ভরদুপুরের মেটকাফ হলও সেক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে আদর্শ টাইম মেশিন।