No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মেরিকামায়া সাতকাহন : এসআইইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়লা-শহর কার্বনডেলের কথা

    মেরিকামায়া সাতকাহন : এসআইইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়লা-শহর কার্বনডেলের কথা

    Story image

    সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ও লেক

    একবিংশ পর্বের পর

    “কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে।

    লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন, ওগো, তায় জাগাইনু রে।”

    নতুন এক জীবন শুরু হলো।

    সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিকে বলা হয় এসআইইউ – ঠিক যেমন ছিল আইএসইউ। দুটোই সরকারি অনুদানের বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যপ্রতীচ্যের এই ইলিনয় রাজ্য আশেপাশের রাজ্যগুলো থেকে একটু আলাদা। এসব কথা অবশ্য পরে জেনেছি। আমেরিকা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না, এবং নরমাল-ব্লুমিংটনে আড়াই বছর কাটিয়েও তেমন কোনো ধারণাই মার্কিন মুলুক সম্পর্কে গড়ে ওঠেনি।

    জীবনটা লড়াই করতে এতো ব্যস্ত ছিল যে চোখ তুলে “দেখবো এবার জগৎটাকে, কেমন করে ছুটছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে” এসব করার সময় পাইনি।

    কবিতা লুকিয়ে ছিল নিষ্ঠুর গদ্যের তাড়নায়।

    প্রথম দুটো বছর বড্ড বেশি টানাপোড়েনে কেটে গেছে। বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম। তাই, ইলিনয়ই বা কী, পাশের রাজ্য আইওয়াতে সেই একবারই যাওয়া যেখানে গিয়ে সেই বাঙালি ছাত্রদের ঘরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছিলাম, এদিকে পূর্বদিকের রাজ্য ইন্ডিয়ানা, আর দক্ষিণ-পশ্চিমের মিসিসিপি নদী পেরিয়ে মিসৌরি যেখানে আছে শিকাগোর মতো আর একটা বড়ো শহর সেন্ট লুইস। তারপর আছে কেন্টাকি, টেনেসি, শিকাগোর আরো উত্তরে আরো হাড়হিম করা ঠাণ্ডার রাজ্য উইসকনসিন, মিশিগান।

    এসআইইউ আমার কাছে আমেরিকাকে ভালো করে দেখার প্রথম মজবুত সোপান। একটু একটু করে সেসব কথা বলা যাবে এই স্মৃতিকথায়।

    লড়াই করে, খুব বেশি লড়াই করে যখন মানুষ বেঁচে বিজয়ী হয়ে উঠে আসে, তখন তার চরিত্র একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। যারা সে রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যায়নি কখনো, তারা বুঝতে পারবে না। আমার দেশের স্মৃতিকথা ঘটিকাহিনিতে আমি লিখেছি কলকাতায়, বাংলায় আমার জীবনযুদ্ধের কথা। আমার মায়ের বেয়াল্লিশ বছর বয়সে ক্যানসারে মৃত্যুর কথা। আমার দাদার মতো ছোটমামা বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক খুনের কথা। নকশাল সিপিএম কংগ্রেসের খুনোখুনির রাজনীতির মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠার কথা। বাবার ঊষা সেলাই মেশিন কারখানায় লকআউট আর আমাদের প্রায় না খেয়ে থাকার অবস্থার কথা। ক্লাস সিক্স সেভেন থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সংসারের দোকান বাজার সবকিছু করার কথা।

    আর লিখেছি রাডারবিহীন স্টীমারের মতো যৌনশিক্ষাহীন বয়ঃসন্ধিকালের যন্ত্রণার কথা।

    সবকিছুই ছিল যুদ্ধ। সুন্দরবনের নাম-না-জানা গ্রামের এক কলেজে চার বছর থাকা এবং অধ্যাপনার অভিজ্ঞতাকেও সেই যুদ্ধের একটা পর্ব বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সবকিছুই আমাকে কামারশালার হাপরের আগুনে লোহাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে কাস্তে কোদাল তরোয়ালের মতো মজবুত, শক্তিশালী করে তুলেছে। সে মানসিক ও শারীরিক শক্তি আগেই অর্জন করা না থাকলে আমি আমেরিকায় সফল হতে পারতাম না। শেষ হয়ে যেতাম। অনেককেই দেখেছি শেষ হয়ে যেতে। রণে ভঙ্গ দিয়ে দেশে ফিরে যেতে। আবার দেশে আমাকে অনেকেই বলেছে, সে মনের জোর তাদের ছিলো না বলে তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকায় পড়তে কখনো আসেনি। এতো কষ্ট, এতো পরিশ্রম, এতো দুঃখদারিদ্র্য সহ্য করার ক্ষমতা তাদের ছিলো না।

    খুব কম মানুষেরই থাকে। আমার ছিল।

    ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমার জীবন যেন একটা প্রচণ্ড রক্তাক্ত যুদ্ধ। সে যুদ্ধে মার খেয়ে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যখন আবার উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমি এক নতুন মানুষ। যেন একটা পুনর্জন্ম হয়েছে। একথা আমি বলছি হৃদয়ের একেবারে ভেতর থেকে। আমি অনুভব করেছিলাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদ হোক, ভারত বাংলার পথিকৃৎ রামমোহন বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণদেব বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলাম সূর্য সেন সুভাষ বসু সবাই মিলেই তাঁদের শিক্ষার এক এক কণা আমার রক্তের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়ে গেছেন।

    না, আমি শিকাগো ধর্মমহাসভায় আগুন ছুটিয়ে জগৎবিখ্যাত হইনি। না, আমি ব্রিটেনের হাউস অফ কমন্সে গিয়ে সতীদাহের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিইনি। আমি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে বসে বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে আইন তৈরি করিনি। আমি গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল প্রাইজ পাইনি।

    তাঁরা মহামানব। কিন্তু আমিও তাঁদেরই বাংলা, তাঁদেরই কলকাতার রাস্তার ধুলোতে হেঁটে গেছি। অতি ক্ষুদ্র হলেও তাঁদের চরিত্রের আমিও এক অংশীদার।

    আমি আমার যুদ্ধে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। কিন্তু মরে যাইনি, পালিয়ে যাইনি।

    এবারে আমি বিজয়ী এক যোদ্ধা। আমার সামনে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাওয়ার এক বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ।

    রোমান্টিকতা যতই আসুক না কেন লেখার মধ্যে, বাস্তব জীবনটা বড্ড বেশি বাস্তব। তিন বছর হতে চললো দেশে যাইনি। এবং কবে যেতে পারবো, কেউ জানে না। এর মধ্যে আমার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু আমরা যেতে পারবো না।

    তবে তার আগে এই এসআইইউ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়লা-শহর কার্বনডেলের কথা একটু বলি।

    কয়লা শহর বলে, এবং কার্বনডেল নাম শুনেই বোঝা যায় সেকথা। তার কারণ, গভীর কয়লাখনি না থাকলেও স্ট্রিপ মাইন যাকে বলে, অর্থাৎ অগভীর খনি, তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এলাকার আশেপাশে। সেখানকার অবস্থা ভালো নয়। দক্ষিণ ইলিনয়, দক্ষিণপূর্ব মিসৌরি, উত্তরপশ্চিম কেনটাকি, আর কিছুটা টেনেসী এইসব জায়গা নিয়ে এই এলাকা। চরম দারিদ্র্যপীড়িত। আমেরিকার দারিদ্র্য যে কতটা বাস্তব এবং বিশাল, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই আমার ছিলো না। ঠিক যেমন আজকে এই দুহাজার বাইশ সালের শেষেও আমাদের দেশের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ মার্কিন মুলুকের দারিদ্র্যের কথা শুনলে হেসেই উড়িয়ে দেবেন। মিডিয়া ও হলিউড-বলিউড সম্পূর্ণভাবেই মগজধোলাই করে ফেলেছে।

    অথচ, কার্বনডেলের ইউনিভার্সিটি এলাকার একটু বাইরে বেরিয়ে গেলেই গরিব আমেরিকা। ছোটো ছোটো অরণ্যে ঘেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ, যেখানে না আছে কোনো বড় শিল্পবাণিজ্য, না আছে উপার্জন করার কোনো রাস্তা। কয়লাখনি, কিছু স্কুল, আর জঙ্গলের কাঠ কাটার টিম্বার ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া মানুষের জীবিকার আর কোনো সংস্থান নেই। অ্যানা-জোন্সবরো, ম্যাকান্ডা, তারপর লিটল ইজিপ্ট নামের একটা এলাকা তার মধ্যে আবার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শহর কায়রো – এসব এলাকায় দিনের বেলাতেই দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ মধ্যবয়সী মার্কিনিরা আধময়লা জীনস আর মাথায় একটা বেসবল ক্যাপ পরে রাস্তার ধারে কাঠের বেঞ্চিতে বসে বীয়ার খাচ্ছে।

    ম্যাকান্ডা, দক্ষিণ ইলিনয়, ডেসোলেট টাউন, দারিদ্র

    হতাশায় জর্জরিত। এদের ইংরিজি এ্যাকসেন্ট একেবারেই অন্যরকম। এদের জীবনের দর্শনও একেবারেই আলাদা। এই একই রাজ্যের উত্তরে গমগমে শিকাগো শহর। আর এখানে দিনের বেলাতেই আমাদের স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের পিছনে হরিণ ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় ঘন গাছপালার মধ্যে।

    এরা কোনোদিন হাইস্কুলের গণ্ডী পার হয়নি, এলাকার বাইরে কোথাও কখনো যায়নি, পৃথিবী তো দূরের কথা, এই এলাকার বাইরেই কখনো কোথাও যায়নি। সেই আমাদের সুন্দরবন কলেজের ক্লাসরুমে যেমন গ্রামের লোকেরা উঁকিঝুঁকি দিতো ক্লাসের মধ্যে প্রফেচার কী শেখাচ্ছে তা দেখার কৌতূহলে, আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতো যে প্রফেচাররা এখন পাঁচশো টাকা মাইনে পায় যদিও তখনই আমাদের মাসিক উপার্জন ছিল বারোশো টাকা, এখানেও সেই একই গল্প। ক্লাসরুমের মধ্যে যদিও কখনো গ্রামের মানুষ ঢোকেনি, কিন্তু বাইরে তারাও অনেকেই মনে করতো, এই এসআইইউতে এতো বিদেশি ছাত্রছাত্রী কেন, লোকাল ছেলেমেয়ে কি কম পড়িয়াছে যে বাহির হইতে, ইত্যাদি।

    একদিকে দক্ষিণী আমেরিকার অতি রক্ষণশীল সমাজ ও খৃস্টান চার্চ, আর একদিকে দারিদ্র্য ও অশিক্ষা – এর যোগফল আমাদের দেশের সেই রূপ কানোয়ারের সতীদাহ সমর্থন করা রাজস্থান, গুজরাট আর চম্বলের মতোই। দাক্ষিণাত্যের খৃস্টানরা হলো সাদার্ন ব্যাপটিস্ট, যারা একসময়ে দাসপ্রথার সবচেয়ে তীব্র সমর্থক ছিল।

    এসব কথাও একটু একটু করে পরে জেনেছি। তারপর অভিজ্ঞতা হলো লিটল ইজিপ্ট ও তার রাস্তাঘাটের মধ্যে দিয়ে ঘোরাঘুরি করার সময়ে এক পুরোনো স্কুলবাড়ি দেখার। সেখানে মিউজিয়ামের মতো করে রাখা আছে পুরোনো দিনের টয়লেট। স্টুডেন্ট ও টিচারদের জন্যে দুটো আলাদা মুখ ধোয়ার, জল খাবার বেসিন – একটার ওপরে লেখা আছে “হোয়াইটস অনলি।”

    বর্ণবৈষম্যবাদী টয়লেট

    নিজের চোখে দেখলাম এই আমেরিকাটা দুদিন আগেও কেমন ছিল, তার কথা।

    আমার বাবার শৈশবের এক বন্ধু ভানুকাকু কাস্টমসের বিরাট অফিসার। তাঁর মেয়ে মুনমুনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বহুকাল আগেই, কলকাতায়। খবর পেয়েছিলাম মুনমুন থাকে পশ্চিম টেনেসীর জ্যাকসন বলে একটা ছোট্ট শহরে। সেখানে মুনমুনের স্বামী আইআইটি ইঞ্জিনীয়ার রবিদা আর দুটো ছেলেমেয়ে।

    পশ্চিম টেনেসীর ছোট্ট শহর জ্যাকসনের ব্ল্যাক কলেজ

    কার্বনডেল আসার আগেই কথা হয়েছিল যে শীতের ছুটিটা আমরা ওদের বাড়িতে গিয়ে কাটাবো কিছুদিন। অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ। সেইমতো হিসেব করে আমাদের সেই বিশাল বাদামী রঙের ক্যাঁচক্যাঁচে প্লীমুথ ভ্যালিয়েন্টকে ইউনিভার্সিটির ফ্রী পার্কিং এরিয়াতে এখানেই থাকো তুমি বুঝলে কোথাও যেওনা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমরা আড়াইজনের পরিবার একদিন রবিদার গাড়িতে করে তিনঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে হাজির হলাম ঐতিহাসিক মেমফিস শহরের কাছাকাছি ঘুমন্ত জ্যাকসনে।

    আমাদের ছমাসের মেয়ে বলতে গেলে এর আগে কখনো কোনো বাঙালিকে দেখেনি।

    বলতে গেলে, আমরাও দেখিনি। একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। তাদের কথা না বললে এ গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

    (চলবে...)

    *আমেরিকা-জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রখ্যাত মানবধিকার কর্মী ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলামে চলছে ‘মেরিকামায়া সাতকাহন’।

    ধারাবাহিকভাবে প্রতি শুক্রবার সন্ধে ৬টায় প্রকাশিত হচ্ছে শুধুমাত্র বঙ্গদর্শন-এ।

    ‘মেরিকামায়া সাতকাহন’-এর সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @