মেলাচ্ছে সেই মেলা

জল-হাওয়ার দাঁত উঠলেই মানুষের মুখ ঘুরে যায় মেলার দিকে। এই সাপ তো এই হাঁস, এখানে তালশাঁস তো ওখানে মাছ। কোথাও পট তো কোথাও ডোকরা। আবার কোথাও বা টেরাকোটা- বাংলার মেলার রকমফের কম নয়। হালফিল মেলার মুখ ঘুরছে বৃদ্ধির দিকে। শুধু আর্থিক নয়, শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক।
দিনকাল কীভাবে বদলে যায় ! ডোকরা শিল্পীদের মেলা উপলক্ষে বর্ধমানের দরিয়াপুর গ্রামের ডোকরা মেলায় গতবার প্রথম এসেছিলেন জেলাশাসক। তা দেখে অবাক গ্রামের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী রামু কর্মকার। তিনি বলছিলেন, ‘নোংরা মদের ভাটি আর আবর্জনার ভরা এই গ্রামে কেউই আসতে চায় না। এই প্রথম দরিয়াপুরে কোন মেলা হল। নিজেদের শিল্পকর্মকে ধরেই বর্ধমানে ডোকরাশিল্পীদের গ্রাম দরিয়াপুরের এগিয়ে যাওয়া। এই বদল কেমন? গত দু-বছর ধরে দরিয়াপুরে আসা এক ডাক্তারবাবুর মতে, ‘এখন কল কম পাই, লোকের স্বাস্থ্যও অনেক ভাল হয়েছে। গত দু-বছর ধরে গ্রামে রোগ কমছে।’ এরই পাশাপাশি বাড়ছে শিল্পীদের আত্মবিশ্বাস। এদেরই একজন সুরেশ কর্মকার। ইনি আগে অর্ডার পাওয়ার পর ডোকরার মূর্তি গড়তেন। এখন নিজেই একজন উদ্যোগী।
দরিয়াপুর থেকে অনেক দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় দুখুশ্যাম চিত্রকরের গলাতেও এর প্রতিধ্বনি শোনা গেল। দুখুশ্যাম বললেন, ‘৭ বছর ধরে এই যে আমরা গ্রামে পটের মেলা- পটমায়া করছি সেটাই বদলে দিল গ্রামটাকে।’ পিংলাতে এক চক্কর মারলেই সেকথা বোঝা যায়। ঘরে ঘরে শৌচাগার, আবর্জনাহীন পুকুর, ছোটদের স্কুলে যাওয়া গ্রামের ৭০টি পরিবারের আয় মাসে গড়ে ৮০০ থেকে ৮০০০ টাকা হয়ে যাওয়া- সবকিছুই বলছে লোকশিল্প আর তাকে ঘিরে মেলা গ্রামীণ অর্থনীতির হাল ফেরাচ্ছে। এর সুফল পেয়েছেন পিংলার মোট ২০০০ শিল্পী এবং ৮০০টি পরিবার। একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিন দিনাজপুরের কুশমন্ডীর কাঠের মুখোশ মেলায়। সেখানকার মুখোশ শিল্পী শঙ্কর দাস প্রথম মেলায় বিক্রি করেছিলেন ২০০০০ টাকার মুখোশ। এবারের মুখোশ মেলায় তা অনেকটাই বেড়েছে।
বৃদ্ধি শুধু আর্থিক নয়, বেড়েছে গ্রামবাংলার লোকশিল্পীদের আত্মসম্মান, তারা খুঁজে পেয়েছেন আত্মপরিচয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ব্যাঙ্ক আগে গ্রামের গরীবের ঋণ দিতে চাইত না। মহিলা হলে তো অবস্থা আরও খারাপ। বাঁকুড়ার বিকনার মহিলা ডোকরা শিল্পীরা সবাই দল বেঁধে স্থানীয় ব্যাঙ্ক থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়মিত শোধ করছেন তারা।
নতুন গ্রামের কাঠ পুতুল শিল্পী বিজয় সূত্রধর বলছিলেন মানুষ যে ভাবে তাদের শিল্পকর্মগুলিকে ব্যবহার করতে পারেন তারা ঠিক সেই ভাবেই জিনিসগুলিকে তাদের কাছে হাজির করেছেন। তাই নতুন গ্রামের প্যাঁচা বাড়ির তাক থেকে উড়ে বসছে চেয়ারের কাঠের পায়ায়, কিংবা টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডে। পটের নকশা রাঙিয়ে দিচ্ছে টি-শার্ট। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডির শিল্পীরা শিব-কালীর মুখোশের পাশাপাশি বাঁশের গুড়ি দিয়ে বানাচ্ছেন আদিবাসী আর মিশরীয় মুখোশ। এ ভাবেই বাজারে আসছে মাদুর, কাঁথাস্টিচ কিংবা শীতলপাটির ব্যাগ। স্থানীয় মেলা থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের প্রদর্শনী সব জায়গাতেই মানুষের আগ্রহ বলছে বাংলার লোকশিল্পের এই নব কলেবর তারা বেশ পছন্দ করছেন। লোকশিল্পের এই নবকলেবর কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই। মেলা তাকে বাঁচার রসদ দিচ্ছে।