ভুঁইকম্বল গাছড়া থেকে ত্বকের রোগের ওষুধ- আশা দিচ্ছেন বাঙালি গবেষকরা

মানবসভ্যতার লিখিত ইতিহাসের আগের যুগ থেকেই অরণ্যবাসী মানুষ মূলত প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করত। ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বললেই মনে পড়ে আয়ুর্বেদের কথা। কিন্তু আয়ুর্বেদের বাইরেও বিভিন্ন জনজাতির মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও ঔষধির এক বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, যার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় খুলে দিতে পারে এক নতুন দিগন্ত। সেই সম্ভাবনাকেই নতুন করে উন্মোচিত করলেন পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকরা। তাঁরা এমন একটি উদ্ভিদ খুঁজে পেয়েছেন, যার নির্যাস সারিয়ে তুলতে পারে সোরিয়াসিস নামের ত্বকের এক দুরারোগ্য ব্যাধিকে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ফাইটোমেডিসিন-এ। গবেষণায় সহায়তা করেছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের গবেষকরা। গবেষণাটি করেছেন সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিপ্লব কুমার মোদক, অধ্যাপক শঙ্কর ভট্টাচার্য, গবেষক-ছাত্র- অনীক প্রামাণিক, পার্থ গড়াই, দেবাঞ্জন সরকার। গবেষণার একটি ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নবকুমার মণ্ডল এবং ছাত্র-গবেষক অর্ঘদীপ মণ্ডল। গবেষণাপত্রটির প্রথম প্রণেতা হলেন দেবাঞ্জন সরকার।
সোরিয়াসিস রোগীর পা
সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিপ্লব কুমার মোদক বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “আমরা বহুদিন ধরেই ট্রাইবাল মেডিসিনের উপর গবেষণা করছি। আদিবাসীরা অন্য সব ক্ষেত্রের মতো, চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পান না। কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন গাছের অংশ ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেন। যদিও তাঁদের সব পদ্ধতি সঠিক নয়। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা নিজস্ব পদ্ধতিতে রোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে রয়েছেন। সে সবের পর্যবেক্ষণ ও কারণ নির্ধারণ করাই ছিল আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।” সেভাবেই তাঁরা খুঁজে পান ভুঁইকম্বল নামের একটি উদ্ভিদ, যা পাওয়া যায় পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া অঞ্চলে। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম প্রেমনা হের্বাসিয়া। এই গাছের নির্যাস কার্যকরী হতে পারে ত্বকের সোরিয়াসিস রোগের বিরুদ্ধে।
শঙ্কর ভট্টাচার্য
সোরিয়াসিস একটি অটো-ইমিউন ডিজঅর্ডার। এইক্ষেত্রে মানুষের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি শরীরের বিরুদ্ধেই কাজ করতে শুরু করে। ফলে দরকারের থেকে বেড়ে যায় কোষ বিভাজন। অধ্যাপক মোদকের কথায়, “এই রোগে ত্বকের উপরে অতিরিক্ত স্তর তৈরি হয়, চামড়া খসে পড়ে, র্যাশ হয়, ব্যথা হয়, রক্তপাতও হতে পারে। এই রোগ প্রাণঘাতী নয়, কিন্তু জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। তার থেকেও বড়ো কথা, এই রোগ গোটা জীবনকালে সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায় না।” শঙ্কর ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে জানান যে, এই রোগ শুধু ত্বক নয়, ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরের অন্যত্রও। হাড়ে আক্রমণ করতে পারে, নষ্ট করে দিতে পারে হার্টের ভালভ। তাছাড়া, এই রোগে আক্রান্ত মানুষ সমাজে বেরোতে লজ্জা পান, অপ্রস্তুত হন। সামাজিক বুলিং-এর স্বীকার হন অনেকক্ষেত্রে। তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনে জানা গেল, বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। বংশগত কারণ, বিশেষ কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, স্ট্রেস ইত্যাদি। তবে এই রোগ ছোঁয়াচে নয়। এই রোগের বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো স্টেরয়েড এবং NSAID ভিত্তিক, যা খরচসাপেক্ষ এবং অতিরিক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত। বিশেষ করে যে সমস্ত রোগীর গ্যাসট্রিক বা কোলাইটিস-এর সমস্যা রয়েছে, তাঁদেরকে বাজারচলতি ওষুধগুলো খাওয়ানো যায় না।
অধ্যাপক বিপ্লব কুমার মোদক
এই জায়গা থেকেই শঙ্করবাবুরা ভুঁইকম্বল গাছের শিকড়ের নির্যাস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। ইঁদুরের দেহে কৃত্রিম ভাবে সোরিয়াসিস রোগটি সৃষ্টি করে সেই নির্যাস প্রয়োগ করে অভাবনীয় ফল পেয়েছেন তাঁরা। এই নির্যাসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। শঙ্করবাবু জানান, “আমরা প্রথমে মিথানলের মাধ্যমে গাছের নির্যাসটিকে পৃথক করি। তারপর কিছু কোষের উপর পরীক্ষা করে দেখি। সেখানে সফল হওয়ার পর অ্যানিমেল ট্রায়াল করা হয়।” তাঁর কথায় জানা গেল যে, তাঁরা নির্যাসটিকে প্রথমে ইঁদুরের ত্বকে মলমের মতন ব্যবহার করেছেন, যার কার্যকারিতা ছিল বাজারচলতি ওষুধগুলির কাছাকাছি। এরপর ইঁদুরগুলিকে যখন নির্যাসটি খাওয়ানো হয়, তখন তা অভাবনীয় ফল দিয়েছে। এছাড়া, বাজারচলতি ওষুধগুলিতে কিডনি বা লিভারের সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে তেমন কিছু তো হয়ইনি, বরং কার্যকারিতা বেড়ে গেছে অনেকটাই। জানা গেল, ম্যাক্রোফেজ নামক একটি ইমিউন কোষই সোরিয়াসিস রোগের অন্যতম কারণ। ভুঁইকম্বল গাছের শিকড়ের নির্যাস, ম্যাক্রোফেজ কোষের বিশেষ প্রোটিন অণুর কার্যকারিতা কমিয়ে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
দেবাঞ্জন সরকার
বিপ্লববাবু বলেন, “জঙ্গলমহলের ট্রাইবাল মেডিসিন নিয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ ও বিশদ গবেষণা সম্ভবত রাজ্যে প্রথম। এই নির্যাস এরপর মানবদেহে পরীক্ষা করে তার কার্যকারিতা দেখতে হবে। তা করার এক্তিয়ার আমাদের নেই। তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে কেন্দ্রীয়, রাজ্য বা বেসরকারি সংস্থাদের।” তাঁদের দাবি, এই নির্যাস থেকে যদি শেষ পর্যন্ত ওষুধ তৈরি করা যায়, তবে তা দারুণ কার্যকরী হবে এবং তার খরচ হবে অনেক কম। এই আত্মবিশ্বাসের কারণ মূলত দুটি। প্রথম কারণ অবশ্যই গবেষণার সফলতা। আর দ্বিতীয়? অধ্যাপক শঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “এই ধরনের অ্যানিমেল ট্রায়াল সফল হলে তা সাধারণত মানুষের ক্ষেত্রেও সফল হয়। আর এত বছর ধরে আদিবাসীরা এই নির্যাস ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। তাই এই নির্যাস থেকে ওষুধ তৈরি করে তা মানবদেহে প্রয়োগ করলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।” অধ্যাপক বিপ্লব মোদকের কথায়, বর্তমানে ভারতবর্ষে সোরিয়াসিস রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সমস্ত দেশবাসীর ০.৮ থেকে ৪ শতাংশ মানুষের। রোগটি হতে পারে যে কোনও বয়সী মানুষেরই। তাই এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া খুব জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা দুজনেই। কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে শঙ্করবাবু বলেন, “আমরা নিজস্ব ফান্ড থেকে এই গবেষণা চালিয়েছি। যদিও গবেষণার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রগুলি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিনেছিলেন রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের দেওয়া ফান্ড থেকে। সেজন্য আমরা রাজ্য সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আনুষঙ্গিক সমস্ত খরচই নিজস্ব ফান্ড থেকে করতে হয়েছে।” আর এই প্রসঙ্গে বিপ্লববাবু যোগ করেন, “এরকম বহু গবেষণা মাঝপথে আটকে যায় টাকার অভাবে। যদি ফান্ড আরও বাড়ানো হয়, তাহলে আরও চমকপ্রদ গবেষণা করা সম্ভব।”
পার্থ গড়াই