ময়ূরপঙ্খী ও শিবগৌরী পালা : বর্ধমানের দুই লুপ্তপ্রায় লোকনাট্য

পূর্ব বর্ধমান জেলার সঙ্গে এমন অনেক কিছুই জুড়ে আছে, যেগুলির খ্যাতি ও লোকপ্রিয়তা সন্দেহাতীত। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক লোকনাট্য সংস্কৃতি। বর্ধমানের নানান জায়গায় লোকনাট্য চর্চা একসময় প্রচুর দেখা গেলেও বর্তমানে তা অনেকটাই কমে এসেছে। এহেন নিভু নিভু অবস্থায়, এখনও দুই জায়গায় দুই রকম লোকনাট্যের দেখা মেলে—ময়ূরপঙ্খী ও শিবগৌরী পালা।
ময়ূরপঙ্খী
পূর্ব বর্ধমান জেলার অনেক জায়গায় ময়ূরপঙ্খী গানের চল ছিল। বর্তমানে রায়না থানার নাড়ুগ্রামে নাড়েশ্বর শিবের গাজনে ময়ূরপঙ্খী গানের রেওয়াজ আছে। এই গানের বয়স দুশো-আড়াইশো বছর। জামালপুর, রায়না ইত্যাদি গ্রামে, দুটি পাড়ার মধ্যে ময়ূরপঙ্খী গানের লড়াই হয়ে থাকে। কী এই ময়ূরপঙ্খী গান?
ময়ূরপঙ্খী গানের রেওয়াজ আছে। এই গানের বয়স দুশো-আড়াইশো বছর। জামালপুর, রায়না ইত্যাদি গ্রামে, দুটি পাড়ার মধ্যে ময়ূরপঙ্খী গানের লড়াই হয়ে থাকে।
আমরা জানি, রাঢ় অঞ্চল গড়ে উঠেছে দামোদর-কে কেন্দ্র করে। নদীকেন্দ্রিক জায়গাগুলোতে নৌকার গুরুত্ব অপরিসীম। এই জলযান জড়িয়ে আছে লোকসংস্কৃতির মধ্যে। এই লোকনাট্যে, গরুর গাড়ির উপর বাখারি দিয়ে কাঠামো তৈরি করে রঙিন কাগজে সাজিয়ে, প্রতীকী ময়ূরপঙ্খী নৌকো গড়া হয়। সামনে ও পেছন থেকে দেখে ময়ূরের মতো মনে হয়। গাড়ির মাঝখানে বসে বাদকের দল। বাজনার মধ্যে আগে দেখা যেত ঢোল, কাঁসি। বর্তমানে খোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ব্যবহৃত হয়। গানের শুরুতে ‘আরে ঐ’ বলে একটানা সুর লাগানো হয়। ‘জয় শ্রী নিতাই প্রেমানন্দ হরিবল’ ধ্বনির সঙ্গে খোলের আওয়াজ ওঠে। তারপর শুরু হয় এক দলের সঙ্গে অন্য দলের প্রতিযোগিতা। শিল্পীদের পোশাক হয় গেরুয়া পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা। শিল্পীরা মূলত খেতমজুরের কাজ করেন, কেউ টোটো চালান। দুই দলের মধ্যে একদল কৃষ্ণের ভূমিকা নেয়, অপর দল রাধার। রাধাকৃষ্ণের উক্তি প্রত্যুত্তরের মধ্যে দিয়েই নাটকের সংলাপ প্রকাশ পায়।
শিবগৌরী পালা
বর্ধমান শহরের বুকে বড়ো নীলপুর, কাঞ্চননগর ও অনেক বাঙাল কলোনিতে একসময় খুব জাঁকজমক ভাবে এক প্রাচীন লোকনাট্যের দেখা মিলত। পরিচিত ছিল ‘শিবগৌরী পালা’ নামে। বর্তমানে তার শেষ নির্যাসটুকু টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে নীলপুরের এক মালাকার পরিবার। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পরিবারের সদস্যরা শুধুমাত্র ভালোবেসে এই পালার সঙ্গে যুক্ত। এই পালা তাঁরা বাড়ির নীলপুজো উপলক্ষেও করে থাকেন। পালা করে যা পারিশ্রমিক পান তাতে সংসারে একবেলার ভাত জোটানোও অসম্ভব। তাঁদের কথায়, ভোলানাথের চরণে সেবা করেই তাঁরা খুশি।
কাঠের খোদায়ে রয়েছে নাগনাগিনী, শিব-গৌরীর ছবি। তাকে ঘিরেই শুরু হয় নাচ। সংলাপের মধ্যে দিয়ে ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় হরপার্বতীর অভাবী সংসারের ছবি।
শিবগৌরী পালাগান বাংলা বছরের শেষ মাস অর্থাৎ চৈত্র মাসের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত হয়। শিবের আরাধনা এর মূল লক্ষ্য। উঠোন বা চাতালের মাঝে বসানো থাকে সিঁদুর মাখানো লম্বা বেলকাঠ। কাঠের খোদায়ে রয়েছে নাগনাগিনী, শিব-গৌরীর ছবি। তাকে ঘিরেই শুরু হয় নাচ। সংলাপের মধ্যে দিয়ে ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় হরপার্বতীর অভাবী সংসারের ছবি।
বিষয়বস্তু সাদামাটা। শিব হলেন ভোলেভালা ভবঘুরে। সংসারে তাঁর অভাব। তাই ধর্মের অনুষঙ্গ আসে না। দুঃখের বারোমাস্যা, সুখের সন্ধান, পতি পত্নীর ভালোবাসাই উঠে আসে পালাতে। গানের সুরে ধরা পড়ে বাংলার মাটির টান। গৌরী বসে বসে চাল ডাল বাছে। শিব তখন গৌরীকে দেখে বলেন, “শিব বলে ও গৌরী তুমি তো বড়োই সুন্দরী/ আমি একটু হয়েছি বুড়ো তাতে তোমার ক্ষতি কী?”। তারপর শুরু হয় শিবগৌরীর ঝগড়া, প্রেম, ভালোবাসা। এগুলোও গানের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়—“শিব চলিল বিয়ার বেশে/ নারদ বাজায় বীণা/ সব সখীরা সাইজ্যা এল বরণ কুলো নিয়া”। পোশাকে থাকে সস্তার চুল দাড়ি লাগানো, রং ও জীর্ণ পোশাক। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ডুগডুগি, ভাঙা টিনের ত্রিশূল, খাড়া, বাঁশি। শান্তিপাড়ার শম্ভুবাবুই এখন পালাগান করেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাই সাজেন— রঞ্জিত মালাকার(শিব), প্রশান্ত মালাকার(গৌরী), সঞ্জিত মালাকার (কালী), সুশান্ত মালাকার(রাধা)। সঙ্গীত পরিবেশনায় বাঁশি ঢাক ঢোল নিয়ে বসেন গোপাল মালাকার। পালা শেষে ঘাটে যান কাঠ নিয়ে, ওখানে কাঠকে স্নান করিয়ে বাড়িতে নিয়ে আনা হয়, তারপর কাঠের উপর জল ঢালা হয়। লোকেরা মানত করেন ভক্তিভরে।
এই পালা মূলত অন্ত্যজ নমঃশূদ্র বা অন্য বর্গের তপশিলী উপজাতির মানুষেরাই করতেন। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু পল্লীগুলিতে এর প্রচলন বেশি ছিল। এখন শুধুমাত্র টিকে রয়েছে বড়ো নীলপুরের শান্তিপাড়া। একসময়ের জমজমাট এই পালা মাঝ রাতেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবেশিত হত। মানুষ তখন ঘুমচোখে জল দিয়ে মনের আনন্দে দেখতে বসে যেতেন। কিন্তু আজ সেই শিল্প হারিয়ে যাবার পথে। পালার শিল্পীদের জীবনযাপনও খুব কষ্টে কাটে। তাঁদের কেউ বাদাম বেচেন, কেউ ফেরি করেন, কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। একদিকে অভাবের সংসার, অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতি এসবের মধ্যে পড়ে গিয়ে শিল্পীরা আর মনোরঞ্জনের কথা ভাবতে পারেন না। দুমুঠো পেটের ভাত জোগাড়েই তাঁরা এখন ব্যস্ত।
বর্তমানে এই নাট্যশিল্পের অবলুপ্তির নেপথ্যে রয়েছে গ্লোবালাইজেশন। এখন প্রত্যেকটা মানুষের হাতে হাতে মোবাইল মানুষের চিন্তা মননকে গ্রাস করছে। মোবাইলের মধ্যে বিচিত্র রকমের যে আনন্দলাভ করা যাচ্ছে, সেই জায়গা থেকে ঘর ছেড়ে বাইরে আর কেউ তেমন নাটক দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। তাতে শিল্পীরাও বিপদের মুখে পড়েছে। শিল্পীরাও আর সেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন না এই ধরনের নাট্যচর্চায়। তাই সময়ের দাবী মেনে যদি চর্চায় এমন কিছু আনা যায় অথচ তার মূল রস ও প্রকৃতি বজায় থাকে তাহলে হয়তো আলো দেখা যাবে।