বর্গি ঠেকাতে কলকাতায় তৈরি হল ‘মারহাট্টা ডিচ’, কলকাতাবাসী হয়ে উঠলেন ‘ডিচার্স’

“…একদিন মারহাট্টা ডিচ লেন দিয়ে হাঁটছি, দেখছি জজ সাহেবের বাড়ির সিঁড়িতে বসে বিড়ি বাঁধছে কয়েকজন আর সিংহটার মুখের ভিতরে বসে আছে একটা পায়রা। (ফটিক সাহার মুদি দোকানটাকে তিন টুকরো করে তিন ছেলে বসছে) কটকটি-তেলেভাজার দোকানটায় মোবাইল রিচার্জ হয়, জেরক্সও। ডাল বড়াটা কী ভালোই না করত।”
অনেকদিন আগে একটি সংবাদপত্রে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা হারিয়ে যাওয়া কলকাতা সম্বন্ধীয় ‘বাগবাজারের আশালতা’ পড়তে গিয়ে যেখানে চোখ আটকে গেছিল, তা হল ‘মারহাট্টা ডিচ’। কলকাতায় এরকম কোনও লেনের অস্বিত্ব আছে বা ছিল বলে তো আগে শুনিনি…অতএব, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতেই হল।
হুমমমম… কলকাতার গলিতে গলিতে গুপ্ত গল্প রয়েছে, তা আরও একবার টের পেলাম খতিয়ে দেখার পর। যা পেলাম-
১৭৪০ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁ বসলেন বাংলার মসনদে। আর, তখনকার দিনে যা হত আর কি, মসনদে বসার আগে একচোট যুদ্ধ। বসার পরে তো সর্বক্ষণই যুদ্ধ। আজ অমুকের আক্রমণ, তো পরশু তমুকের। আলিবর্দির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সিংহাসন দখলের দু-বছরের মধ্যে ১৭৪২-এর এপ্রিল মাসে তিনহাজার ঘোড়সওয়ার আর একহাজার পদাতিক সেনা নিয়ে মারাঠা থেকে উজিয়ে এলেন ভাস্কর পণ্ডিত, আমাদের বর্ধমানে। চৌথসহ অন্যান্য কর আদায় করতে। শুধু আদায় করা কি আর কাজ? মারধোর, লুঠতরাজ চলল। ‘মহারাষ্ট্র পুরাণে’ যার বর্ণনা দিয়ে গেছেন স্বয়ং গঙ্গারাম চক্রবর্তী—
“এই মতে জত সব গ্রাম পোড়াইয়া
চতুর্দ্দিকে বরগি বেড়াএ লুটিয়া।।
কাহুকে বাঁধে বরগি দিয়া পিঠ মোড়া
চিত কইরা মারে লাথি পায়ে জুতা চড়া।।
রুপি দেহ দেহ বোলে বারে বারে
রুপি না পাইয়া তবে নাকে জল ভরে।।”
বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে চলেছিল লুঠ। নারীর ওপর অকথ্য অত্যাচার তো আছেই। আলিবর্দি খাঁ প্রথমে জুত করে উঠতে পারেননি ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে। পালিয়ে বেঁচেছিলেন।১৭৪২-এর ৬ই মে সারাদিন বাংলার রাজধানী মকসুদাবাদে লুট চালায় ভাস্কর পণ্ডিত। পরে বেশ কৌশল করে ভাস্করজিকে ঘরে ডেকে হত্যা করেন বাংলার নবাব। মারাঠা দস্যুরা অবশ্য তারপরেও অপ্রতিরোধ্য। ফের আসে রঘুজি ভোঁসলে। কখনো বাংলার গ্রামাঞ্চল, কখনো উড়িষ্যায় তারা ঘাঁটি গড়ে আর লুঠ চালায়। আর তাদের ধাওয়া করতে করতে ছুটে মরেন আলিবর্দি খাঁ। এসবের জন্যই তো ওই ছড়াটার সৃষ্টি: ‘ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োল/ বর্গি এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/ খাজনা দেব কি সে...’
শিবাজির দেশ মহারাষ্ট্র থেকে আসা ভয়ঙ্কর বর্গিদের কথা ‘অন্নদামঙ্গলে’ লিখে গেছেন ভারতচন্দ্রও।
চারপাশে যখন এসব হচ্ছে, কলকাতার লোকদেরও মনে ভয় চেপে বসল। এই বুঝি বর্গির দল আসে। ইংরেজ সাহেবরা যেটুকু ব্যবস্থা করেছে তা বিপুল মারাঠা শক্তির কাছে নস্যি। তাই কলকাতার মানুষ নিজেরা ঠিক করল, শহর জুড়ে খাল কাটা হবে। সাত মাইল লম্বা ৪২ গজ চওড়া খাল। কোম্পানির কাছ থেকে আগাম টাকা নেওয়া হল। ২৫০০০টাকা। বৈষ্ণবচরণ শেঠ, রামকৃষ্ণ, রাসবিহারী ও উমিচাঁদরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন যে জনগণ এই টাকা ফিরত দেবে। গোটা কলকাতা উপুড় হয়ে পড়ল খাল কাটতে। ছয় মাসের মধ্যে তিন মাইল খাল কাটাও হয়ে গেল। মারাঠারা আক্রমণ করলেও, ব্যাটারা যেন ওই খালে আছাড় খেয়ে মরে—এই আশায়। ইংরেজরা কিছু পারুক, না-পারুক সেই খালের গালভরা একটা নাম রেখেছিল—‘মারহাট্টা ডিচ’। মারাঠা থেকে ‘মারহাট্টা’ আর ‘ডিচ’ হল পরিখা বা খাল। বাগবাজার স্ট্রিট থেকে শুরু করে যানবাজার হয়ে বেগবাগান পর্যন্ত দৌড়ল খাল। তারপর থেমে গেল। খাল আর সম্পূর্ণ হল না। মারাঠাদের সঙ্গে কী একটা রফা হয়ে গেল নবাবের। ফলে, অনেক কষ্টে তৈরি মারাঠা ডিচ আধাখেঁচড়া হয়ে থেকে গেল। পরে, ১৭৯৯-তে তার ওপরেই তৈরি হল আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোড। খানিকটা হ্যারিসন রোডও। আর বাকিটা নাকি শহরের জঞ্জাল জমেই বন্ধ হয়েছে। বাগবাজারে মারাঠা ডিচ রোড নামে আজও সেই স্মৃতি রয়েছে—কলকাতার আত্মরক্ষার স্মৃতি।
তবে, শেষ পর্যন্ত আসেনি বর্গিরা। কিন্তু, এহেন হামলে পড়ে খাল কাটার বহর দেখে চারিদিকে কলকাতাবাসীর একটা নতুন নাম রাষ্ট্র হয়ে গেল—‘ডিচার্স’। অর্থাৎ খাল-কাটে যারা। মারাঠা দস্যুরা কলকাতাবাসীদের ক্ষতি করেনি ঠিকই, কিন্তু নাম খারাপ করে দিয়ে গেছিল। কিছুদিনের জন্যে হলেও!
ছবি ঋণঃ
পুরানো কলকাতার চালচিত্র (২য় খণ্ড), অনিন্দ্য বিকাশ সেন