‘মেয়েলি’ হয়ে যাওয়ার ‘ভয়ে’ অনেক ছেলেকেই নাচ ছাড়তে বাধ্য করা হয়

পর্ব ৫
টিচার্স ডে আজকাল যেমন পালিত হয় আমাদের ছোটোবেলায় এইভাবে হত না ঠিক। আমরাই একটু উঁচু ক্লাসে উঠে এসব উদযাপন শুরু করি যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে। তবে তার অনেক আগে গুরুপূর্ণিমা দেখেছি। আমাদের নাচ-গান-আঁকার স্কুলে গুরুপূর্ণিমা হত। গুরু আসলে পথপ্রদর্শক। তিনি ভগবান। কিন্তু প্রতি বছর টিচার্স ডে এলে আমার এক ছোটোবেলার বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ে।
আমাদের স্কুলে মে মাসে ক্লাস শুরু হলে আমায় ভর্তি করানো হত অগাস্টের পর। বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য আমার পরিবারে ছিল না। আর প্রতি বছরই নতুন যারা ক্লাসে আসত আমি তাদেরও অনেক পরে ভর্তি হতাম বলে আমায় তারা আরও নতুন ভাবত। ক্লাসে খানিক নিশ্চুপ, ভাবুক বাচ্চাগুলো যেমন হয় তেমন ছিলাম। কথা বলতাম না। কিন্তু পরীক্ষার নম্বর বেরোলে দেখা যেত আমি বহু বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি এত দেরি করে ভর্তি হবার পরেও। স্কুলের যে-কোনও অনুষ্ঠানে আমি শুধু নাটক বা সমবেত সংগীতে অংশগ্রহণ করতাম তা নয়, নাচও করতাম। নব্বই দশকের গোড়ায় আমাদের ছোট্ট বেসরকারি স্কুলে এত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সব অনুষ্ঠানে আমার একটা নাচ বাঁধা থাকতই।
কিন্তু ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আমার এই অধিকারে ভাগ বসাতে এল নতুন একটি ছেলে। তার আগে প্রথাগতভাবে কখনও নাচ শিখিনি। হাত-পা সুন্দর করে নাড়াতাম গানের সুরে, তালে ওইটুকুই। কিন্তু এই ছেলেটি তখন ভরতনাট্যম শেখে। কী অপূর্ব মুদ্রা! কী এক্সপ্রেশন! ওই ছোটোবেলার আমি যেন ওর কাছে আসতে আসতে ম্লান হয়ে যাচ্ছিলাম। আমায় তখন গ্রুপ-এ নাচতে হত আর ও পেত সোলো নাচ। খুব হিংসা হত আমার! তবে ওই ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে মারাত্মক জমে উঠল। আমরা এক সময় অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু হয়ে গেলাম। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্স, সিক্স থেকে সেভেন, এইট। আমি নিজেও তখন নাচ শিখতে শুরু করেছি। আর বলতে দ্বিধা নেই মেন রোলগুলো আমার ওই বন্ধুর থেকে খানিক ছিনিয়েই নিচ্ছিলাম। কালমৃগয়া-তে আমি ঋষিকুমার, আরও নানা স্ক্রিপ্টে আমার নাচ বেশি। এমনকি একবার টিচার্স ডে-তে আমার সেই বন্ধু অবাক পৃথিবী গানের ওপর একক-নৃত্য করে আর আমাকে ছটি সিনিয়র দিদির মাঝখানে নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জছায়া নাচতে হলে আমি এতই ভালো সেই নাচ করি যে সকলে আমারই উচ্চ প্রশংসা করতে থাকে। আমার বন্ধু আমার মতো হিংসুটে মনের ছিল না, কিন্তু ওর নিশ্চয়ই কষ্ট হত।
একটা সময়ের পর দেখতাম আমার বন্ধু স্কুলে কম আসত। আসলেও নাচ আর করতে চাইত না। ওর মা বলত, ‘নাচের স্কুলেও যায় না। পড়াশোনাও কম করে। কী জানি কী হয়েছে!’ আমাদের মধ্যে এমন যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা করে তাদের কখনও জিজ্ঞেস করা হয় না কেন সে এমন করছে। পরিবর্তে তাকে বকা হয়, মারা হয়, দোষারোপ করা হয়। কেন একটি ছাত্রের যে ওই ছোটোবেলা থেকেই ভালোবেসে নাচ করে তার আর ভালো লাগে না নাচ করতে? আসলে আমার ওই বন্ধুর সেই সময় জানা ছিল না ছেলে হয়ে সে যে আমাদের সমাজে নাচ করছে তাতে তার কপালে বহু টিপ্পনী জুটবে। মানুষ ভালোরকম হাসাহাসি করবে। বাচ্চা ছেলে নাচলে লোকে প্রশংসা করে একটা সময় পর্যন্ত কারণ সে তখনও ছোটো, কিন্তু ছেলে আরেকটু বড়ো হলেই ‘মেয়েলি’ হয়ে যাবার আশঙ্কায় তাকে নাচতে বারণ করা হয়। কী একটা সৌভাগ্যে আমাকে এই হেনস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি কিন্তু আমারই মতো একটি ছেলেকে ওই ছোটোবয়সে ‘লেডিস’, ‘ছক্কা’, ‘হোমো’, ‘বৌদি’ বলে ডাকা হয়েছে। ডেকেছে আমাদেরই বন্ধুবান্ধবরা। বন্ধুদের গার্জেনরাও! জীবনের এমন পর্যায়ে এগুলো বলা হত যখন আমরা এসবের মানেও বুঝতাম না। কিন্তু ওই কথাগুলোর মধ্যে যে একটা গা রিনরিনে ঘৃণা থাকত সেটা উপলব্ধি করতে সেই ছোটোবেলাতেও কোনও অসুবিধা হত না। সেই ঘৃণার জন্যই হয়তো আমার বন্ধু নাচের স্কুলে যেতে চাইত না কিংবা নাচ করতে চাইত না অথবা স্কুলে গেলে যদি নাচে অংশগ্রহণ করতে হয় সে জন্য ফাংশানগুলো যত কাছে আসত সে স্কুল কামাই করা শুরু করতো।
আমাদের স্কুলে শুধু যে অ্যানুয়াল ফাংশান হত তা নয়। নেতাজির জন্মদিন, রিপাবলিক ডে, রবীন্দ্রজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস, টিচার্স ডে, চিলড্রেন্স ডে- নানা রকম অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। সবকটা অনুষ্ঠানই পরিচালনা করতেন টিচাররা কেবল শিক্ষক দিবস ছাড়া। শিক্ষক দিবসে আমরা সব নিজেরা করতাম। শিক্ষকদের সেদিন ছুটি। তাঁরা দর্শক হতেন কেবল। ওই এক শিক্ষক দিবসে, তখন আমরা ক্লাস নাইনে পড়ি, সে-সময় আমি আর আমার সেই বন্ধু শেষ বারের মতো ডুয়েট নেচেছিলাম। ধিতাং ধিতাং বোলে। আমাকে সেদিনই ও বলেছিল,
‘আমাকে আর কখনও নাচতে বলিস না। আমার ভালো লাগে না।’
‘কেন? কত ভালো নাচিস তুই, এরকম ছেড়ে দিচ্ছিস কেন?’
‘কী জানি, সত্যিই আর ভালো লাগে না।’
‘আমি যে নাচের স্কুলে শিখছি ওখানে শেখ। শিখবি?’
‘আমি তো ভরতনাট্যম করি। তোদের তো কথক।’
‘তাহলে তোর স্কুলটায় যা। কাকিমা বলছে সব বন্ধ করে দিয়েছিস!’
‘ওখানে তো আর কোনওদিনই যাব না।’
‘কেন?’
‘গুরুজি এমন সব করে আমার কেমন লাগে। আই হেট!’
আরও পড়ুন: রিনা জানা : ওডিসি নৃত্যের ভানুরেখা গণেশন
এই ‘এমন সব’ করার অর্থ সেদিন বুঝিনি। অনেক পরে উপলব্ধি করেছি। এতদিন যা ভাবতাম ওর নাচ ছাড়ার কারণ তার থেকেও তবে ভয়াবহ কোনও কারণ ছিল যা সে কোনওদিন কাউকে বলতে পারেনি। এক সময় আমার সেই বন্ধু আমাদের স্কুলটাই ছেড়ে দেয় মাধ্যমিকের পর। আমাদের স্কুলে আর ইলেভেন-টুয়েলভ পড়েনি। আজকের মতো মোবাইলও ছিল না তেমন সেই দু-হাজারের শুরুর দিকে। তাই আমাদের আর তেমন দেখা হয়নি কোনওদিন। কিন্তু যে নাচ সে ভালবাসত কত ছোটোবেলা থেকে, যার জন্য সমাজের সব টিটকিরি কম বয়সেও মাথা পেতে নিয়েছিল সেই নাচের গুরুর হাতেই যৌনহেনস্থা হওয়া তার প্রাপ্য ছিল না। শুধু কি তাই? আরও কত কাহিনি- গুরুর শিষ্যকে কোথাও চান্স না দেওয়া, বড়োলোক বাড়ির ছেলেমেয়েদের বেশি সুযোগ করে দেওয়া, গুরু-প্রফেসরের কাছে প্রাইভেটে নাচ শেখেনি বলে পরীক্ষায় না বসার কড়া ব্যবস্থা করা, কেবলমাত্র নাচের পোশাক কোনও এক সময় গুরুকে না জানিয়ে কিনেছে বলে সারাজীবন শত্রুতা করে যাওয়া, স্বজনপোষণ, আবার অনেক অর্থ নিয়েও এতটুকু না শেখানো- এমন সব পরবর্তীকালে বহু শিল্পীর মুখে শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছি। আজ যদি নাচের জগতে সত্যিকারে কখনও কোনও মি-টু আন্দোলন সংগঠিত হয় তবে কত যে বেদনাবিধুর কাহিনি উঠে আসবে, কত চাপা-পড়া অপরাধ জানতে পারা যাবে আর কত নিষ্ঠুরতার ইতিহাস প্রকাশিত হবে তার ইয়ত্তা নেই!
চলবে...
____
কলকাতাকেন্দ্রিক শাস্ত্রীয় নৃত্যের চাপা-ইতিহাস ও নানা শিল্পীদের বর্ণময় জীবন নিয়ে ভাস্কর মজুমদারের কলামে চলছে বঙ্গদর্শন.কম-এর নতুন ধারাবাহিক – নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু।