শঙ্খ ঘোষের নতুন গদ্যের বই ‘নিরহং শিল্পী’

মানুষটা কেমন? ‘অপরিচিত’ কারও প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন সকলের কাছেই সুবিদিত। বিশেষত ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক সেই মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা যখন জরুরি হয়ে পড়ে। এখন সে মানুষের কাজ সম্পর্কে যদি আমার ধারণা থেকে থাকে, তখন প্রশ্নটার গভীর অভিপ্রায় হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তিনি কেমন। কাজ দিয়ে যদি আমি তাঁকে, তাঁর পরিচয়কে নিজের মতো ক’রে গড়ে থাকি তা হলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের আগে শঙ্কা কাজ করে। আমার নির্মাণে তিনি যেমন সেই নির্মাণটুকু অক্ষত থাকবে তো? নাকী একদম ভিন্ন অভিজ্ঞতায় খান খান হয়ে যাবে সেসব? আবার দেখব হয়তো তাঁকে গড়তে যতটুকু চিন্তার মাটি নিয়েছিলুম, সেটুকুতে কুলোচ্ছে না, আরও অনেক উপকরণের প্রয়োজন যার ভাঁড়ারঘর আমার আমার মেধা ও আবেগের ‘ক্রয় ক্ষমতা’-র বাইরে।
এই তৃতীয় বিকল্পটিকে বার বার জেগে উঠতে দেখছি। পড়ছি শঙ্খ ঘোষের নতুন গদ্যের বই ‘নিরহং শিল্পী’। ‘শিল্পী’ শব্দটির সম্প্রসারিত নিহিতার্থটিকে গ্রহণ ক’রে লেখক বলছেন, ‘চলচ্চিত্রের ,সংগীতের, নাট্যের, চিত্রের, ভাস্কর্যের, সাহিত্যেরই শুধু নয়, শিল্পী কেউ হতে পারেন জীবনেরও, যাপনেরও’। এই জীবন শিল্পীরা এসেছেন লেখকের জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন রূপ নিয়ে। কর্মজগতে তাঁরা সুবিখ্যাত, কৃতী, চর্চিত। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন পর্বে কী ভাবে কখন নিজের পরিচয়কে ছাপিয়ে যাচ্ছেন, জীবন পাত্র উছলিয়া হয়ে উঠছেন ব্যতিক্রমী, প্রকৃত অর্থেই ‘ নিরহং’। সে রকমই কিছু স্মৃতিকথা নিয়েই ‘নিরহং শিল্পী’।
সব স্মৃতি দেখা- ছবি নয়, কিছু শোনা- ছবিও আছে। ‘শুনেছিলাম প্রাইম মিউজিকের ইন্দ্রজিৎ সেনের কাছে। তাঁদের কোম্পানি থেকে মান্না দে-র একটি সিডি প্রকাশ করতে চান ইন্দ্রজিৎ, রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। কিন্তু মান্না দে রাজি নন...অনেক অনুনয়ের পর শেষপর্যন্ত অবশ্য মানতে হলো অনুরোধ, গাইবেন মান্না দে’। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু রেকর্ডিং-এ যাওয়ার আগে তিনি ভালো কোনও রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চাইলেন ইন্দ্রজিৎ সেনের কাছে। ইন্দ্রজিৎ শোনালেন কিছুদিন আগে প্রকাশিত বাংলাদেশের তরুণী শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসার অ্যালবাম থেকে গান। শঙ্খ ঘোষ লিখছেন, ‘ তারপর ইন্দ্রজিতের ভাষায় গান শুনতে শুনতে ওঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বললেন-এ কী গান শোনালে তুমি? এ তো সাক্ষাৎ মা সরস্বতী। এরপর কি আর আমার গান গাওয়া মানায়?’ এখানেই শেষ নয়, ইন্দ্রজিতের মাধ্যমে ফোনে যোগাযোগ করে তরুণী শিল্পীকে বললেন, কী গান গেয়েছ তা জানো না মা। অতীতে পড়া শ্লোক স্মরণ করে লেখক উচ্চারণ করেন, ‘যিনি নিজে মান প্রত্যাশী না হয়ে অন্যকে মান দেন, ঈশ্বরস্তবে কেবল তারই আছে অধিকার। কেবল ঈশ্বরস্তবে নয়, শিল্পেরও স্তবে’।
রাধামোহন ভট্টাচার্য, বসন্ত চৌধুরী, মান্না দে, লেডি রাণু মুখার্জি, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, নির্মল কুমারী মহলানবিশ, রাণী চন্দ, সুখময় ভট্টাচার্য শাস্ত্রী, অমিতা সেন, প্রবোধচন্দ্র সেন, শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, লীলা মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শশিভূষণ দাশগুপ্ত এবং আরও কত কৃতী মানুষের স্মৃতি বহন করছে কৃশকায় অথচ আকর এই গ্রন্থ।
‘আমিত্ব’- খণ্ডণের উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে পাতা জুড়ে। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষের সমাপ্তি উৎসবে সেবার শান্তিনিকেতনে সাহিত্য জগতের চাঁদের হাট। ঘর আলো ক’রে বসে আছেন মধ্যমণি সমরেশ বসু। রয়েছেন সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এরকম আরও অনেকের সঙ্গে লেখক। হঠাৎ খবর এলো সকলের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিভায় ও রূপে তিনি তখন খ্যাতির চূড়ায়। শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু অবাক কাণ্ড। কণিকা এসে বিনম্রভাবে কবি-সাহিত্যিকদের কাছে সই চাইতে শুরু করলেন। প্রথমে থতমত খেলেও পরে কৌতুক সহকারে সকলেই গায়িকার আবদার মেটালেন। কিন্তু লেখক পরে সই দেবেন বলে কথা দিয়ে নিজের লাজুক স্বভাবের মর্যাদা রাখতে সমর্থ হলেন। ক্লাইম্যাক্স কিন্তু অন্য। ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগানের গায়কী নিয়ে বিশ্বভারতীর ইংরাজির অধ্যাপকের অপমান সহ্য করেছেন কণিকা। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংগীতভবন থেকে ইস্তফা দেওয়ার। এ রকম একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতে বোধ করি পাশে থাকার বার্তা দিতেই শঙ্খবাবু ও আরও কয়েকজন গেলেন শিল্পীর বাড়ি। গিয়ে দেখলেন সামনের ঘরে বসে কণিকার পদত্যাগপত্র মুসাবিদা ক’রে দিচ্ছেন তাঁদেরই বন্ধু দীপক মজুমদার। স্মৃতিকথকের কথায় ‘একটু পরে আমরা উঠে আসব যখন, দ্রুত তিনি (কণিকা) সরে গেলেন অন্য ঘরে। ফিরে এসে সেই স্বাক্ষরখাতাখানি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেনঃ বলেছিলেন তো সইটা দেবেন পরে...’। সংগীত ভবন তাঁকে ছাড়েনি। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতেও রবীন্দ্রগানের সম্রাজ্ঞীর বিনীত সই প্রার্থনার দৃশ্য কল্পনা করুন পাঠক। ‘এ আমি’- কে যথার্থই ‘ আবরণ’ বলে জ্ঞান হবে।
বরিশালের চন্দ্রহার গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন লেখকের বাবা। ছোটবেলা থেকেই বাবার সেরা ছাত্র অরুণের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়তে মা-কে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী করেন এখন অরুণ? জেনেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের নামী অধ্যাপক। তখন থেকেই স্বপ্ন একদিন ছাত্র হতে হবে এই অরুণের। পরে জানলেন যিনি অরুণ তিনিই শশীভূষণ দাশগুপ্ত, বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক। আর তাঁর ছাত্র হওয়ার আগেই জানলেন অন্য শশীভূষণকে। দেশভাগের পর লেখকের বাবা এ পাড়ে খড়গপুরের ইন্দা অঞ্চলের একটি স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ডাক পাঠালেন তাঁর অরুণকে মফঃস্বলের স্কুলে এসে ছাত্রদের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য। বরেণ্য শশীভূষণের পাণ্ডিত্যের দ্যুতিতে তখন চমকিত বিদ্বৎ মহল। তিনি এলেন স্কুলজীবনের প্রধান শিক্ষকের ডাকে দূর মফস্বলে। ছাত্রদের বললেন, ‘তোমাদের আজ যিনি প্রধান শিক্ষক, তাঁরই পায়ের কাছে বসে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আমি প্রথম পাঠ পেয়েছি, তাঁর বিষয়ে জেনেছি’। ‘ এ কথাগুলি যখন তিনি বলছেন, জ্ঞানে গরিমায় তিনি বাবার চেয়ে অনেক বড়ো। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে এই কথা তিনি বলতে পেরেছিলেন সেদিন, সেটা নিছক বিনয়ের প্রকাশ নয়। সেটা এই বোধের প্রকাশ যে অল্প বয়সে যতটুকু ইশারা আমরা পাই আমাদের যৎসামান্য স্কুলশিক্ষকের কাছে, তার অসীম একটা উৎসগত মূল্য আছে, আছে একটা বহতা মূল্য’।
‘আত্মনি জ্ঞাতে সর্ব বিজ্ঞাতং ভবতি’- নিজেকে জানলেই সবকিছুকে জানা যায়। আর সব কিছুর মধ্যে, জগতের খুঁদ কুঁড়োর ভিতর দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে গেলেই বসতে হয় জীবন মশায়ের পাঠশালায়। আর জীবন মশায় বড় কঠিন গুরু ঠাকুর, সব কীর্তিকে অপসারিত ক’রে বার বার জিজ্ঞেস করেন, বুঝলুম অনেক করেচো বটে দেশের জন্যি-দশের জন্যি, তা মানুষ তুমি ক্যামন বটে?
নিরহং শিল্পী/ শঙ্খ ঘোষ/ তালপাতা