No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘মানুষ মারতে আপত্তি নেই। পশু মারতে দ্বিধা’- তপন রায়চৌধুরী 

    ‘মানুষ মারতে আপত্তি নেই। পশু মারতে দ্বিধা’- তপন রায়চৌধুরী 

    Story image

    ২০০৮-এর শীতের এক সকালে মুখোমুখি হয়েছিলাম ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর। সঙ্গে ছিলেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। ‘ইউরোপ দর্শন’, ‘ইউরোপ পুনর্দর্শন’, ‘ভীমরতিপ্রাপ্তের পররতি চর্চা’ পর বাঙালি তখন মজে ‘বাঙালনামা’-য়। কথার ডালপালা ছড়িয়ে ছিল শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিগন্তে। সাক্ষাৎকারটি প্রথমে’ আহির’ পত্রিকায়, পরে আমার সম্পাদিত ‘সংলাপ সংলাপ’- সংকলনে(প্রকাশক-ধানসিড়ি) মুদ্রিত হয়। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল বঙ্গদর্শনের পাঠকদের জন্য।

     

    ২০০৯-এ ক্ষমতা কাদের হাতে যেতে পারে?

    ২০০৯-এ আদবানি তো বটেই মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে এ আশঙ্কা আমি করি। এবং এই আশঙ্কার কথাটা আমি বিনা দ্বিধায় বলছি।

    অমর্ত্য সেন যেভাবে সব ধরনের ডায়ালগ-এর ওপর ভরসা রাখেন এবং আপনি যে আশঙ্কা করছেন তা যদি সত্যি হয়, যদি মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয় তবে কি dialogue সম্ভব?

    না তখন ডায়ালগ সম্ভব নয়। এদের ভাষাই তো অন্যরকম। এদের ভাষাকে আমি বলব ক্যালেন্ডারের হিন্দুত্ব। হিন্দু ধর্ম সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে এদের কোনো পরিচয় নেই। ক্যালেন্ডারের হিন্দুত্ব বলতে আমি বলব উত্তরপ্রদেশের মুদির দোকানের ক্যালেন্ডার। মোদী গেলেন নীরদ চৌধুরীর কাছে। তো তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে আপনি কী নিয়ে কথা বলতে চান? তো মোদী বললেন হিন্দু ধর্ম। তো উনি বললেন, আপনি সংস্কৃত জানেন? মোদী বললেন, না। উনি বললেন, তাহলে আপনার সাথে আমি কথা বলতে পারি না। আপনি কিছু জানেন না। আপনি সম্পূর্ণ অজ্ঞ (হাসি)। ঠিক বিজেপি নয়, জনসঙ্ঘের ঘনিষ্ট ছিলেন শ্যামাপ্রসাদের সেক্রেটারি। তো তাঁর বাড়িতে আদবানি এসেছেন তিনি বললেন যে তোমরা যে রাম রাম করে লাফাচ্ছ জানো দক্ষিণ ভারতে রামের খুব লো স্ট্যাটাস। ভারতের অনেক জায়গায় মেয়েরা ওকে বিশেষ ঘৃণার দৃষ্টিতে দ্যাখে। তাতে আদবানি বললেন, ইউ বেঙ্গলিজ আর টু ইন্টেলেকচ্যুয়াল। তিনি বললেন তা তুমি যে ব্রেইনলেস হয়ে কাজ করবে সেটা তো... আর সে কাজে তো ফলও হয়। আদবানি বা নরেন্দ্র মোদীর সাথে অমর্ত্য সেনের কি dialogue হবে? সেটা অসম্ভব।

    আরও একটা প্রশ্ন উঠে আসে, যে ভারতবর্ষে বর্তমানে যে হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যার বিশেষ কোনও প্রতিবাদও হচ্ছে না। ফলে ধরুন আমি বা আপনি যারা জন্মসূত্রে হিন্দু অথচ খুব যে পুজো আর্চ্চা করি তেমনও নয়। অথচ যেহেতু এই চাপিয়ে দেওয়া হিন্দুত্বকে contest করিনি তাই জন্যই কি এটা বেড়ে চলেছে?

    দ্যাখো বেড়ে চলেছে তা নয়, আর পুজোআর্চ্চা বেশির ভাগ হিন্দুই করেন না। আমি একটা কথা অনেক দিন ধরে বলছি, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার দুটো দিক আছে, যেটা হতেই হবে। যেটাকে এখন ওরা নষ্ট করার চেষ্টা করছে। আর আমরা বহু সব সংস্কৃতির বহু ধর্মের লোক এখানে বাস করি। এখানে যেটাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয় যেটা সাম্প্রদায়িকতা নয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া নয়। সেটা সম্ভব নয়। সেটা হলে বিপদ। তাহলে এ রাষ্ট্র টিকতে পারে না। আরেকটা হচ্ছে জীবনে ধর্মকে একটা বড়ো স্থান দেওয়া। সাধারণ হিন্দু-মুসলমান সবাই সেটা দেয়। সেটা না করলে বদ লোক এসে ওই যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন সুবিধা পাচ্ছে না তাই নিয়ে অনেকের মনে যে frustration  আছে সেটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। আর সেটা করছেও। পঞ্চাশ কি ষাটের দশকে উত্তর ভারতের বুদ্ধিজীবীরা cow belt বলতেন। খুব যে ভুল বলতেন তা নয়। (হাসি) কিন্তু সব সত্যি কথা সমানভাবে বলাটা...

    তাহলে আমাদের দেশে Secularism-এর বিপদ তো...

    বিপদ হচ্ছে ওইটে, ধর্ম মানুষের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান একটা জিনিস। সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে। যদিও কুসংস্কারটাই এখন বেশি করে আসছে। আধ্যাত্মিকতা বলতে যদি ভক্তিবাদের কথা বলি তবে ভক্তিবাদ আমাদের জীবনে একটা মূল্যবান জিনিস। এটাকে একটু শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা উচিত। আমি নিজেকে নাস্তিক বলি। হিন্দু এবং নাস্তিক। হিন্দু নাস্তিক হতে পারে, যাবালিকদের হিন্দু বলেনি? লোকায়ত দর্শনের লোকেরা হিন্দু ছিলেন না?p

    এদেশে নাস্তিকতার অধিকার মেনে নেওয়া হয় না, সাংবিধানিকভাবে।

    সাংবিধানিক ভাবে কিছুই তো... সংবিধানের সুবিধা হল সংবিধান খুব দুর্বল। যা ইচ্ছে করতে পারো। কিন্তু এটা যেটা হচ্ছে ধর্মে ধর্মে... যেটাকে আমি ক্যালেন্ডারের হিন্দুত্ব বলছিলাম, আদবানি সাহেব গুঁফো রাম সেজে টয়োটা রথে চেপে চলে গেলেন আর পিছনে রক্তের স্রোত বয়ে গেল। এটা বন্ধ করা দরকার। ধর্মের এই ব্যাখ্যা মানে সেই নেকড়ে বাচ্চা আর মেষশিশুর কাহিনীর মতো চারশো বছর আগে তোমার পূর্বপুরুষ কী করেছে এবং আমাদের বস্তির লোকের পূর্বপুরুষ তুর্কিরা না, আমাদের পূর্বপুরুষের তার। সুতরাং তাদের কেটে শেষ করো। দু-হাজার লোককে পুলিশ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মারল। এই যে হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা এটা একদম নতুন ব্যাখ্যা।

    এটা কীভাবে বন্ধ করা সম্ভব?

    এটা বন্ধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার। এটা আম-রাজনীতি দিয়ে হবে না। সামাজিক আন্দোলন দরকার সর্বস্তরের মধ্যে। হিন্দুধর্মের ভিত নিয়েই দরকার শুধু হিন্দুধর্ম নিয়ে নয়। আমি তিনটে article লিখেছিলাম টেলিগ্রাফে। এই communal problem-কে কীভাবে tckle করা যায়। আর ভাবছি আনন্দবাজারে একটা লিখব বলে ‘স্বস্তিকার ছায়া’ বলে। Shadows o Swastika বলে আমার validatary literature আছে। তাকে base করে article-ও আছে। ১৯৯৩ সালে লিখেছিলাম। যখন বিজেপি আসেনি power-এ। বললাম এরা আসবে power-এ। সামাজিক আন্দোলন দরকার যেটা আরএসএস করেছিল আমাদের সেটা দরকার।

    সামাজিক আন্দোলন মানে কি সুশীল সমাজের আন্দোলন?

    না শুধু সুধী সমাজের আন্দোলন না। সবাইকে নিয়ে আন্দোলন। সেখানে সবাইকে বোঝানো হবে যে আমাদের ধর্ম মানে কী আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য কী তার উপরে চাপ থাকবে। কিছুটা গণশিক্ষার দিক থেকে। যারা উদারপন্থী মুসলমান তারা এসব বিষয়ে একদম চুপ করে থাকে। আমি অনেকবার ইরফানকে বলেছি, ইরফান আমার বন্ধু হয়, যে তোমরা একদম চুপ করে থাকো কেন? Why are you leaving is Islam to these rascals? সেটাও তাদের মধ্যে যাদের সাহস আছে, মেয়েদের মধ্যে বরং কিছু সাহস আছে। শাবানা আজমি একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আসলে আমার মুশকিল হয়েছে আমার বয়স হয়ে গেছে এদেশে সবসময় থাকি না। গরমের সময় থাকি না। একটা গরম, এখানে থাকলে মরে যাবে। পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল বিদেশে আছি। কিন্তু এটা younger people leadership নিতে হবে।

    হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আত্মসমালোচনার জায়গাটা... আমাদের না হয় আত্মসমালোচনার একটা ঐতিহ্য আছে তা বরাবর দেখে আসছি।

    থাকবে না কেন আত্মসমালোচনা। আজকে তসলিমা নিয়ে যে হচ্ছে। তসলিমা কী আর লিখেছেন রোকেয়া বেগমের লেখা যদি পড়ো। তিনি তো নাম করে লিখেছেন অমুক মুসলমান তমুক মুসলমান। আমার দাদা এই করতেন, আমার দাদা মানুষ কেটে জলে ভাসিয়ে দিতেন। এইসব, এইরকম ভাবে লিখেছেন, আজকে হলে তো ওর গলা কেটে ফেলত। কী লিখেছেন! লিখেছেন কোরান পুরুষ মানুষের লেখা। কোরান মানুষের লেখা বললেই গলা কেটে ফেলার অবস্থা। তাও আবার কবে লিখেছেন সেই 19th century-তে।

    স্যার, ভারতবর্ষ নিয়ে আপনার যে ভাবনা যে আশঙ্কার কথা বললেন, তাকে ঠেকাতে যে সামাজিক আন্দোলনের কথা বললেন তা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী?

    না আশাবাদী আমি এখন আর নই। আমার ধারণা এই তথাকথিত হিন্দু রাজত্ব আসছে। একে ঠেকানোর শক্তি আমাদের উদারপন্থীদের নেই। যাকে এই অসভ্য শক্তি secular বলেন। এরা আসলে ভারতের যে উদারপন্থা তাই ভারতের প্রাচীনপন্থা। এটাই ভারতের মূলকথা। অন্য কিছু করতে পারে ভাবতে পারে, কিছুদিনের জন্য মারামারি করতে পারে মাঝে মাঝে, কিছু প্রধানত আমরা একসাথে থেকে কাজ করেছি। নানান সভ্যতা সংস্কৃতি। রাস্তায় বেরিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটাই তুমি দ্যাখো না। আমরা কতকিছু খাই। দক্ষিণ ভারত বাদ দিলে সারা ভারতে সবাই মোগলাই খাবার খায় unless he is a vegetarian। এরা তো আবার ব্রহ্মচারী ও vegetarian। আদবানী vegetarian কি না আমি জানি না। এ লোকটি ভয়ঙ্কর। হিটলার vegetarian ছিলেন। (হাসি) মানুষ মারতে আপত্তি নেই। পশু মারতে দ্বিধা।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @