মনসাঘট : দুই বাংলার লোকশিল্পের প্রাচীন উপকরণ

শিবের মানস কন্যা থেকে সর্পদেবীর নাম হয় মনসা। বাংলায় শ্রাবণ মাসের শেষ দিন তথা শ্রাবণ সংক্রান্তিতে বাংলার ঘরে ঘরে মনসা পুজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই মনসা দেবীকে কাল্পনিক রূপদান করে পুজো করার বেশ কয়েকটি মাধ্যম প্রচলিত রয়েছে। তারমধ্যে অষ্টনাগ, নাগঘট ও মনসাঘট বিশেষ উল্লেখযোগ্য এর মধ্যে মনসাঘট হল, বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম একটি উপকরণ। পূর্ববঙ্গের বরিশালের বাসিন্দাদের এই মনসাঘট পুজো করার রীতি বহু প্রাচীন একটি প্রথা।
দেশভাগের পরে বরিশালের ছিন্নমূল কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একটি অংশ এপার বাংলায় এসে বারাসত, দক্ষিণদাঁড়ি, পানিহাটি সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বসতি গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তাঁরা এপার বাংলায় বহন করে নিয়ে আসেন ‘মনসাঘট’ শিল্পরীতি।
অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার ঝালোকাটি অঞ্চলের কুম্ভকারদের একটি বড়ো অংশ বংশপরম্পরায় এই মনসাঘট তৈরি করে থাকতেন। পরবর্তীতে দেশভাগের পরে বরিশালের ছিন্নমূল কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একটি অংশ এপার বাংলায় এসে বারাসত, দক্ষিণদাঁড়ি, পানিহাটি সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বসতি গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তাঁরা এপার বাংলায় বহন করে নিয়ে আসেন ‘মনসাঘট’ শিল্পরীতি। যা ছিল তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এই শিল্পের মাধ্যমে কাঁটাতারের বেড়াজাল পেরিয়ে দুই বাংলার মেলবন্ধন ঘটে। বরিশালের থেকে এপারে চলে আসা শিল্পীদের মধ্যে একজন হলেন রতন পাল। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বরিশালের পাট চুকিয়ে সপরিবারে এপারের পানিহাটিতে চলে আসেন রতন পাল। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন একফালি ঝালোকাটি ও তাঁর আদিনিবাসের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন: মাটির ভাঁড় – স্মৃতি সত্ত্বা ভবিষ্যৎ
দিন তিনেক আগে তাঁর বাড়ি চলে গেলাম। ছোট্ট একফালি ঘরে তখন চলছে শেষ বেলার ব্যস্তময় প্রস্তুতি। রতনবাবুর স্ত্রী শ্রীমতী আলো পালের সঙ্গে আলাপ হল। কথার প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, পানিহাটিতে এখনও কিছু শিল্পী মনসাঘট তৈরি করেন। প্রতিবেশী বিমল পালের পরিবার এখনও মনসাঘট তৈরি করেন। প্রয়াত ক্ষিতীশ পাল তার স্ত্রী মালতী পাল আগে মনসাঘট তৈরি করতেন। এখন মালতী পাল অল্প সংখ্যক ঘট আঁকেন। বরিশালের মনসাঘট গঠনশৈলীর দিক সম্পূর্নরূপে স্বাতন্ত্র্য। এর গঠন কাঠামোটি ভারি নজরকাড়া! মনসাঘটের নিচের অংশটি বেশ খানিকটা স্ফীত হয়ে মধ্যিখানে একটু চাপা। আবার সামান্য স্ফীত হয়ে উপরে অনেকটা সরু হয়ে দুদিকে প্রশস্ত বেষ্টনী তৈরি করে, ঘটের কানার অংশটি সৃষ্টি করে। তখন কানার অংশটি দেবীর শিরোভূষণের ন্যায় দৃশ্যমান হয়। মনসাঘট ছাঁচে ও চাক ঘুরিয়ে হাতের কৌশলে দুইই ভাবে তৈরি করা হয়। এরপর কাঁচা মাটির মনসাঘটগুলি রোদে শুকিয়ে, পরে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হয়। এরপরে আসে রঙ করার পালা।
বরিশালের মনসাঘট গঠনশৈলীর দিক সম্পূর্নরূপে স্বাতন্ত্র্য। এর গঠন কাঠামোটি ভারি নজরকাড়া! মনসাঘটের নিচের অংশটি বেশ খানিকটা স্ফীত হয়ে মধ্যিখানে একটু চাপা।
মনসাঘটের অঙ্কন প্রণালীটিও অনন্য। ঘটগুলিতে প্রথমে খড়ি মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। খড়ি শুকিয়ে সাদা হলে, পরে হলুদ রঙের ব্যবহারে ফুটিয়ে তোলা হয় দেবীর অবয়ব ও গাত্রবর্ণ। পাকা লাল রঙের ব্যবহারে শাড়ি ও কালো রঙের ব্যবহারে চুল, চোখ ও নাক আঁকা হয়। দেবীর চোখ, নাক, ত্রিনয়নটি শিল্পী তাঁর দক্ষ তুলির টানে খুব দ্রুত গতিতে এঁকে ফেলেন! দেবীর চোখের দৃষ্টিটি হয় বিস্ফারিত। এরপরে সাদা রঙের মাধ্যমে দেবীর দুহাতের সাপ ও গহনাগুলি আঁকা হয়।
শিল্পী তাঁর সুনিপুন তুলির স্পর্শে গোটা ঘটটিকে এমনভাবে আঁকেন যেন, গোটা দেবীঘটটিকে গর্ভবতী নারীর আদলে উপস্থাপন করে। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো, একটি গ্রামীণ লৌকিক বিশ্বাস এক্ষেত্রে বরিশালের মানুষের মনে অন্তর্নিহিত আছে। তা হল, সমগ্র বাংলাদেশ ছিল কৃষিনির্ভর দেশ। ফসলের পরিমান জমির উর্বরাশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই মনসাঘটের দেবীকে গর্ভবতী নারীর আদলে আঁকা হয়। কারণ সাপের বংশবৃদ্ধি বিপুল পরিমানে হওয়ার কারণে মনসাঘটকে উর্বরাশক্তির প্রতীকরূপে গড়ে তোলা হয়। মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির কামনায় মনসার এহেন রূপদানের মাধ্যমে আরাধনা করার আড়ালে এটি ছিল একটি অন্যতম কারণ, তা বলাই বাহুল্য!
বিশেষ ধন্যবাদঃ শ্রী রতন পাল ও শ্রীমতি আলো পাল