আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার সংগ্রামী ইতিহাস

আমাদের বাৎসরিক দিনপঞ্জিতে অনেকগুলি ‘দিবস’ আছে। এই সব উদযাপনের বাইরের রূপটি প্রায় একই রকম। তারই একটি হল ২১ ফেব্রুয়ারি- যার নাম ‘ভাষা শহীদ দিবস'। বেশ কিছুকাল ধরেই এই তারিখটি বাঙালির আর কেবল একান্ত নিজস্ব সম্পদ নয়। রাষ্ট্রসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যদা দিয়েছে। কিন্তু বছরে মাত্র একদিন এই দিনটিকে উদযাপন করে আমাদের পার পাবার আর কোন উপায় নেই। কারণ দিনটির গোটা শরীর জুড়ে মিশে আছে আমাদের মুখের ভাষা- যে ভাষা সারা বছর আমাদের দিন-রাত ব্যবহার করতে হয়।
এই ঘটনাকে যদি আমরা কালপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি তাহলে মনে হবে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলাভাষীরাই বোধহয় প্রথম আত্মদানের ইতিহাস রচনা করেছে। কিন্তু এই দাবী যদি একটি ভৌগোলিক গণ্ডিতে সীমায়িত হত তাহলে রাষ্ট্রসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিত না। আসলে ২১ ফেব্রুয়ারি হল ভাষা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। এক ভাষার উপর অপর ভাষার আধিপত্য যুগ যুগ ধরে চাপানোর চেষ্টা হয়েছে। ইংরেজি ভাষা এমনি করেই কব্জা করতে চেয়েছে আইরিশ ভাষাকে। একটা সময়ে ইরানে ফার্সি ভাষাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য আরবি ভাষার দৌরাত্ম্য শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ সংগ্রাম, সৈয়দ মুজতবা আলি তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য নিবন্ধ রচনা করেছেন।
সেই সংগ্রামের ইতিহাস মাথায় রাখলে অনুধাবন করা যাবে যে ২১ ফেব্রুয়ারি কেবল ঢাকার শহীদদের স্মৃতি তর্পণের দিন নয়, সারা পৃথিবীর সমস্ত ভাষা শহীদের স্মরণ চিহ্ন হল ওই দিনটি। এমন একটি দিনকে আমরা কিভাবে ভাবে উদযাপন করব? আমরা কি মনে রাখি সেই দিনে ঢাকার পথে প্রাণ দিয়েছেন কারা? আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, সফিউর রহমান, আর রফিকুদ্দিন আহমেদ কি আমাদের স্মৃতি থেকে হেলায় হারিয়ে যাবেন? ‘লড়ায়ে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে যে কালজয়ী সংগীত রচিত হয়েছে তার গীতিকার যে আবদুল গফফর চৌধুরী এবং সুরকার আলতাফ মামুদ তা কি ভুলেও মনে আসে আমাদের?
কথা হল উজ্জ্বল অতীতের প্রতি আমদের এই ক্ষমাহীন উদাসীনতা কেন? তার একটাই কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাতে আমরা সেই সংগ্রামী ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি সযত্নে তুলে দিইনি। দেখতে দেখতে ২১ তারিখের বয়সও ৬৫ বছর হতে চললো। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ সেই দিনটি আবার আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। অবজ্ঞার অমার্জনীয় অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে পরীক্ষামূলক ভাবে হলেও আমরা একটি সামান্য উদ্যোগের কথা কি ভাবতে পারি?
এই রাজ্যের সরকার স্থির করেছেন পাঠ্যপুস্তকে সিঙ্গুর আন্দোলনের ইতিবৃত্তকে বিশেষ ভাবে স্থান দেওয়া হবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কে বিনীত অনুরোধ - আরও একটি বিষয়কে পাঠ্য-পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানাই। তা হল ভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ৩৪ বছরের বাম জামানায় এই সংগ্রামের কাহিনি পাঠ্যপুস্তকে আসেনি। অথচ বামপন্থীদেরই উদ্যোগটা নেওয়া উচিত ছিল। কারণ ভাষা আন্দোলনের দুই বছর আগে ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলার খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাতজন কমিউনিস্ট কর্মী। ভাষা আন্দোলনের পেছনে এই ঘটনার নিবিড় প্রভাব সকলের জানা।
এই ইতিহাস স্কুল পাঠ্যসূচীর গণ্ডী ছাড়িয়ে বহুদূর প্রসারিত হতে পারে। ভাষা যখন শাসকের হাতিয়ার হয় তখন সে আগ্রাসী। কিন্তু ভাষা যখন আপন গতিতে এগোয় তখন এক ভাষা আরেক ভাষার সহচর হয়ে ওঠে। একে অপরের শব্দ ভাণ্ডার অবলীলায় ব্যবহার করে। ভাষার শরীরেই লুকিয়ে থাকে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, ভাষাই যুগ যুগ ধরে বহন করে আন্তর্জাতিক মৈত্রী। ভাষার ইতিহাসই সভ্যতার সহজপাঠ্য। ভাষার ইতিহাসে লীন হয়ে থাকে ছেলে হারা যত মায়ের অশ্রু। ২১ ফেব্রুয়ারি সেই ইতিহাসেরই এক উজ্জ্বল ফুলকি।