মানাসলুর চুড়ো থেকে—দ্বিতীয় পর্ব

অনেকে জিজ্ঞেস করেন, মানাসলু শৃঙ্গ অভিযানের ভূত আমার মাথায় চাপল কেন? ৮০০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় ওই ‘ডেথ জোন’, সেখানে শারীরিক অসুস্থতা, অর্থাভাব, প্রবল অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করেও আমি কীভাবে রওনা দিয়েছিলাম, তা ভাবলে এখন অবাক লাগে। আসলে, পর্বতারোহণ শেখার সময় আমি যখন প্রথম ‘ডেথ জোন’ শব্দটা শুনি, তখন থেকেই আমার খুব ইচ্ছে ছিল-- এটাকে কেন ডেথ জোন বলা হয় তা জানতে। এবং মানাসলু অভিযানের পর আমি বুঝলাম, দূষিত এবং বিষাক্ত বাতাসে পরিপূর্ণ সমতলের শহরগুলোই আমার কাছে সত্যিকারের মৃত্যু উপত্যকা, পাহাড়ের অধিকতম উচ্চতা-ও আমার জন্য মৃত্যু উপত্যকা নয়।
সামিটের পথে
এই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর, হঠাৎ আমি একাই চলে আসি নেপালে ‘সেভেন সামিট ট্রেকস’-এর অফিসে। আমাকে সেখানে দেখে প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এজেন্সির লোকজন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আমি হয়তো বাবা-মাকে না জানিয়েই নেপাল চলে এসছি। কর্মা শেরপা স্যার ভীষণ ভালো মানুষ, বারে বারে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “তোমার বাবা-মা কি জানেন তুমি এখানে আছ?” সেভেন সামিট ট্রেকস-এর সমস্ত স্টাফেরাই ভীষণ ভালো। আমি যে মানাসলু (পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম) শৃঙ্গ অভিযানে যেতে চাই এবং সেটা যে আমার বাবা-মা জানে-- এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তারা আমার অভিযান-সংক্রান্ত প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরু করেন।
আট হাজার মিটারের শৃঙ্গ অভিযান খুবই খরচসাপেক্ষ। আমি স্পনসর কীভাবে পাওয়া যায়, সেই বিষয়ে একদমই কিছু জানতাম না। কলকাতার রাস্তাঘাট সেভাবে কিছু চিনিও না, কোথায় যেতে হবে জানি না। অভিযানে যাওয়ার আগে, এক মাস ধরে শুধু কলকাতার এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছি। কিছু কর্পোরেট অফিসে গেছি, কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি। উলটে দূষিত বাতাস, ওই সমস্ত কর্পোরেট অফিসের এয়ার কন্ডিশন (আমি এয়ার কন্ডিশন-এ থাকতে অভ্যস্ত নই) এবং অফিসের বাইরে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া—সবটা মিলিয়ে আমার শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ছড়িয়ে যায়। প্রচণ্ড সর্দি, মাথা-যন্ত্রণা, জ্বর, ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতেও পারছি না। তখন এমনই অবস্থা যে, আমার কাছে ডাক্তার দেখানোর এবং ওষুধ কেনার সময় এবং টাকা কোনোটাই ছিল না। তাই, ওষুধের দোকানে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ১০টা অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট কিনে নিলাম।
ঠিক মতো খাওয়ার-ও সময় পাচ্ছিলাম না। টাকা জোগাড়ের চিন্তায় আরও ২ কেজি ওজন কমে গেল। আমি কাঠমান্ডুতে, গোশালা ধর্মশালায়, চলে গেলাম। যদিও, এটাই নেপালের সব চেয়ে সস্তায় থাকার জায়গা, তবুও ওদের টাকা দেওয়ার মতোও পরিস্থিতি আমার তখন ছিল না। আমি বাধ্য হয়েই ওদের অনুরোধ করলাম। আমি চাইছিলাম, যেভাবেই হোক মানাসলু অভিযানের জন্য যতটা সম্ভব টাকা জমা করতে।
আরও পড়ুন
মানাসলুর চুড়ো থেকে—প্রথম পর্ব
কাটমান্ডুর রাস্তায় যাতায়াতের পথে একজন স্থানীয় টেম্পো ড্রাইভার আমাকে বললেন, “তোমার নাক দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে।” শারীরিকভাবে আমি তখনো সুস্থ হইনি। ফলে, এমনটা মাঝেমাঝেই হত। কিন্তু, তখন আমার নিজের দিকে তাকাবার মতো সময়ও ছিল না। আমি খিদেও চেপে রাখতাম। একান্তই সহ্য-ক্ষমতার বাইরে চলে না যাওয়া অবধি খেতাম না ।
আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে চাইছিলাম।
আমি এই ঝুঁকিগুলো নিয়েছিলাম, কারণ আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম-- বেশি উচ্চতায় আমি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠি। আমার ওজন-ও সঠিক ভাবে বেড়ে যায় এবং যে কোনো অসুস্থতা থেকে খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠি।
সামিটের ছাড়পত্র
নেপালের অভিযানগুলোতে হাজারো নিয়ম-কানুন। পারমিট, রয়্যালটি, বর্জ্য-আবর্জনা পরিষ্কার ইত্যাদির জন্য নেপালের সমস্ত সামিট এজেন্সিকেই নেপালসরকারকে প্রচুর পরিমাণ টাকা দিতে হয়। তাই, অভিযানের খরচ কমানো সম্ভব হয় না। তবুও ‘সেভেন সামিট ট্রেকস’ যথাসাধ্য চেষ্টা করে অভিযাত্রীদের থেকে যতটা পারা যায় কম টাকা নেওয়ার জন্য। এবং অভিযাত্রীদের নিরাপত্তার দিকটিও তারা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে।
আমি ১৬ই সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প পৌঁছাই। ওই দিন সকাল থেকেই নাগাড়ে শিলাবৃষ্টি হচ্ছিল। আমি সম্পূর্ণ ভিজে ভিজেই হাঁটছিলাম আর ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। আমার যেহেতু আগে থেকেই শ্বাসনালিতে সংক্রমণ আর জ্বর ছিল, ওই ঠান্ডায় শিলাবৃষ্টিতে টানা পাঁচ ঘন্টা ভিজে সেটা আরও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পোঁছে যায়। আমার কাছে কোনো ওষুধ ছিল না, এমনকি প্যারাসিটামল-ও না। শেরপা স্যারই আমার জন্য কয়েকটা প্যারাসিটামল জোগাড় করে দিলেন ।
শিলাবৃষ্টি মাথায় করেই বেসক্যাম্পে
বেশি উচ্চতায় আমি যে কোনো অসুস্থতা থেকেই খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে থাকি। এবারেও তাই হল। বেসক্যাম্প-এ কর্মা শেরপা স্যার, আমার শেরপা গাইড পেম্বা থেন্ডুক শেরপা এবং অন্যান্য সমস্ত শেরপারাই রোজ আমার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছিও কিনা। যদি আমার ফোনের নেটওয়ার্ক ডিসটার্বড থাকত, ওঁরা তাহলে ওঁদের ফোন থেকেই বাবা মা-র সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতেন। এমনকি, আমি সামিট করার পরেও ওঁরা জানতে চেয়েছিলেন, এতে আমার বাবা-মা খুশি কিনা। এমনকি, ফোনে ওঁরা কথাও বলেছিলেন বাবা-মায়ের সঙ্গে।
মনে আছে, অভিযান শেষ হওয়ার পর আমার কাছে সামান্য কিছু টাকাই অবশিষ্ট ছিল। এমনকি, অভিযানের পর ফেরার সময় স্লিপারের টিকিটও কাটতে পারিনি। কোনোরকমে বাড়ি ফেরার জন্য মিথিলা এক্সপ্রেস ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্ট-এ ফিরেছিলাম একা-একাই। কিন্তু, শেরপারা আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন, খোঁজ নিচ্ছিলেন আমি যাতে ঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছে যাই। পেশাদার সম্পর্কের গণ্ডী এতটা বড়ো হয় না বোধহয়।
আসলে, নেপালের সমস্ত সামিট এজেন্সিই খুব ভালো। সমস্ত শেরপারাই খুব ভালো, খুব সরল এবং খুব দয়ালু।
নেপালও ভীষণই ভালো একটা জায়গা। মেয়েদের জন্যও খুব নিরাপদ। তার জন্যই আমি আমার কাজে ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম এবং এমন একটা অসম্ভব কাজকে সম্ভব করতে পেরেছিলাম। আমার জীবন, বাবা মা-র জীবন মানাসলু-র পায়ে নিবেদন করেই এরকম একটা বিপজ্জনক জায়গায় গিয়েছিলাম। মানাসলু যে তার চূড়ায় আমাকে সফলভাবে আরোহণ করতে দিয়েছে তার জন্য মানাসলু শৃঙ্গের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব।
কিন্তু, সেই আরোহণের সময়েও অনেক ঝুঁকি, বাধা পেরোতে হয়েছে আমায়। সেই গল্প পরে বলছি।
(ক্রমশ)